কৃষকদের না দিয়ে ডিলারদের আলুর বীজ দিচ্ছে বিএডিসি
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে কৃষকদের আলুর বীজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিনাজপুরের কৃষকদের সেই বীজ দেওয়া হয়নি। এতে চলতি বছর আগাম আলুর আবাদ পিছিয়ে গেছে। সময়মতো বিএডিসির আলুর বীজ না পাওয়ায় ১৫ দিন আগাম আলুর চাষাবাদ পিছিয়ে গেছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। এমনকি টাকা দিয়েও ভালো মানের বীজ পাচ্ছেন। এমনকি বিএডিসি কখন বীজ সরবরাহ করবে, তাও জানেন না কৃষকরা। এ অবস্থায় আলু চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলার হাজারো কৃষক। তবে কৃষকদের না দিলেও ডিলারদের বীজ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএডিসির কর্মকর্তারা।
কৃষকদের অভিযোগ, তাদের বিএডিসি থেকে কোনও ধরনের আলুর বীজ সরবরাহ করা হয় না। ফলে বাড়তি দামে ডিলারদের কাছ থেকে কিংবা বেসরকারি কোম্পানির বীজ কিনতে হচ্ছে। সরকারিভাবে আলুর বীজের মূল্য সর্বোচ্চ ৬৪ টাকা কেজি, সেখানে বাইরে থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। পাশাপাশি থাকছে উৎপাদনের শঙ্কা।
সদর উপজেলার ৯ নম্বর আস্করপুর ইউনিয়নের গৌরিপুর এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কোনও বছরই বিএডিসি থেকে আমাদের আলুর বীজ সরবরাহ করা হয় না। বারবার বিএডিসি অফিসে যোগাযোগ করলেও কাজ হয় না। এবারও সময়মতো বীজ পাইনি আমরা। বাইরে থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।’
দুই একর জমির জন্য একটি কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনেছি জানিয়ে এই কৃষক আরও বলেন, ‘সেই আলুর বীজ রোপণ করছি। বারবারই দাবি করেছি যেন বিএডিসি থেকে বীজ দেওয়া হয়। কিন্তু দিচ্ছে না।’
সদরের উলিপুর, মাশিমপুর, আউলিয়াপুর, ঘুঘুডাঙ্গা, গৌরীপুর এলাকা আগাম আলু চাষের জন্য পরিচিত। ইতিমধ্যে অনেক কৃষক বীজ রোপণ করেছেন। আবার অনেকে জমি প্রস্তুত করে ফেলে রেখেছেন। বীজ সংকটে রোপণ করতে পারছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসিতে ধরনা দিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে না।
আউলিয়াপুর এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা ফরিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএডিসি থেকে বীজ দেওয়া হয় না আমাদের। অথচ সরকারিভাবে বীজ দেওয়ার কথা ছিল। শুধু কাগজে-কলমে লেখা বীজ দেওয়া হয়। সত্যিকার অর্থে কৃষকদের কোনও উপকার করছে না বিএডিসি। ফলে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনছি আমরা। এতে ফলন নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। কারণ অনেক বীজ নষ্ট হয়। সাইসাইন জাতের আলুর বীজের কেজি ৮০-৮২, সেভেন ফর সেভেন জাতের আলুর বীজ ৬২-৬৪ টাকা কেজি দরে কিনছি।’
জেলা বিএডিসি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারিভাবে বিএডিসি থেকে কৃষকরা আলুর বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন। এজন্য কৃষক পর্যায়ে সানসাইন জাতের বীজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪-৬৪ টাকা। সেভেন ফর সেভেন জাতের বীজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০-৬১ টাকা। অথচ এই বীজ পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বাইরে থেকে বীজ কিনতে হচ্ছে জেলার কৃষকদের।
বীজ না পেয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানিয়েছেন গৌরীপুর এলাকার কৃষক সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে আলু আবাদ করছি। বিএডিসি থেকে কৃষকদের বীজ দেওয়া হয় শুনি, কিন্তু বাস্ততে কখনও পাইনি। বাইরের ডিলারের মাধ্যমে কিনে আবাদ করি। এতে দাম বেশি পড়ে। কখনও বীজ খারাপ হলে লোকসানে পড়তে হয় কিংবা পথে বসতে হয়। এই ভোগান্তি থেকে কৃষকদের মুক্তি পাওয়া জরুরি।’
মাশিমপুরের কৃষক আসলাম আলী বলেন, ‘আগাম জাতের বীজ পাইনি। পরের যে জাত তারও বীজ দেওয়া হবে না। আমাদের যেতে হয় ডিলারদের কাছে। বেশি দামে কিনতে হয়। এগুলো আমাদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। ডিলারদের সঙ্গে বিএডিসি বীজের লেনদেন ঠিক রেখেছে। কিন্তু যে কৃষকদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সে কৃষকদের দিকে তাকানোর সময় নেই বিএডিসির। এ নিয়ে দায়িত্বশীলদের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’
উলিপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এবার বৃষ্টি হওয়ায় এবং বীজ না পাওয়ায় আগাম আলু আবাদ করা যায়নি। অন্তত ১৫ দিন পিছিয়ে গেছে চাষাবাদ। এরপরও চেয়েছিলাম যাতে বীজ পাওয়া যায়। অন্তত বিএডিসি সহযোগিতা করবে। কিন্তু করেনি। আমরা টাকা দিয়েও ভালো মানের বীজ পাইনি। ফলে বাধ্য হয়ে অবশেষে বেশি দামে নিম্নমানের বীজ কিনে আবাদ করছি। কয়েকবার বিএডিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনও সাড়া দেননি তারা।’
কৃষি উদ্যোক্তা ফরিদুল ইসলামের মতে, মানসম্মত বীজের অভাবে এই এলাকার কৃষক বাড়তি টাকা খরচ করেও ভালো ফলন পান না। আবার কখনও বীজ যদি খারাপ হয় তাহলে লোকসান গুনতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন এখানকার কৃষকরা। বিএডিসি ডিলার ছাড়াও চাষি কিংবা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বীজ বিক্রয় করবে বলে ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কার্যক্রম নেই। অথচ সবচেয়ে বেশি আলু চাষাবাদ হয় এসব এলাকায়। যদি এ ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নেয় তাহলে কৃষকরা উপকৃত হবেন, আলুর উৎপাদন বাড়বে।
দিনাজপুর বিএডিসি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিডার, আমদানিকৃত, প্রত্যায়িত এবং মানঘোষিত এই চার ক্যাটাগরিতে আলুর বীজ ডিলার পর্যায়ে এবং কৃষকের প্রতিষ্ঠায় পর্যায়ে বিক্রি করে থাকে বিএডিসি। উত্তরাঞ্চলের জন্য এ বছর সরকার সানসাইন, কারেজ ও লেডিরোসেটা জাতের আলুর বীজ গ্রেড অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৬৪ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫৪ টাকা দরে বিক্রি করবে। পাশাপাশি সান্তানা, কুইনএনি, সেভেন ফর সেভেন ও মিউজিকা জাতের বীজ সর্বোচ্চ ৬১ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০ টাকা দরে বিক্রি করবে। এ ছাড়া গ্রানোলা জাতের বীজ সর্বোচ্চ ৫৬ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৪৪ টাকা দরে বিক্রি করবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে জেলায় ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি থেকে আলু উৎপাদন হয়েছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার ১৭৫ মেট্রিক টন। জেলার মোট উৎপাদনের মধ্যে ১৫ শতাংশ আগাম আলুর আবাদ করা হয়। এবার আগাম বীজ না পাওয়ায় অনেকে চাষ করতে পারেননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএডিসির জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আলুর বীজ কৃষক এবং ডিলার উভয় পর্যায়ে বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে আগে ডিলারদের দেওয়া হয়। এরপর কৃষকদের আবেদনের ভিত্তিতে তাদের দেওয়া হয়।’
কৃষকদের অগ্রাধিকার না দিয়ে ডিলারকে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৩ সেপ্টেম্বর থেকে ডিলারদের মাঝে বীজ বিতরণ শুরু হয়েছে। কৃষকদের মাঝে সরবরাহের কথা ছিল ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে।’ এত দেরিতে কৃষকদের কেন বীজ দেওয়া হলো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এভাবেই দেওয়া হয়।’