ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


শিক্ষক শব্দটি কলঙ্কিত হচ্ছে


১ মার্চ ২০২৪ ১২:০৮

সংগৃহিত

আমাদের সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায় তা আসলে আমরা কোথাও নিশ্চিত করতে সক্ষম হইনি। এমনকি স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে! ভাবা যায়! এই দুশ্চিন্তা কিন্তু রাস্তা-ঘাটে বিপদের কারণে নয় বরং এই দুশ্চিন্তা হলো যদি সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক নামের অমানুষ চাকরি করেন তাকে নিয়ে! কারণ আজকাল যারা ধর্ষক যারা প্রতারক বা যারা খারাপ চরিত্রের অধিকারী তারা সব জায়গাতেই ভালো মানুষের মুখোশ পরে চাকরি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এদের পদচারণা রয়েছে! এদের নিয়েই যত দুশ্চিন্তা এবং শিক্ষক নামটিকে এরা প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করে চলেছেন। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। শিক্ষকরা নিজেদের সেই পিতার সমান মনোভাব ধরে রাখতে পারেননি।

তাদের কাছে জ্ঞান লাভ করতে আসা তাদের সন্তানসম মেয়েরা তাদের লোভের শিকার হচ্ছে। নিজের অবস্থান এবং পদ ভুলে কেবল হীন মানসিকতা প্রশ্রয় দিয়ে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। আর কোনোদিন হয়তো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ হবে না। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। জাল ছিঁড়ে যে দু’একটা অভিযোগ জনগণের সামনে আসে তাতেই তো চক্ষু চড়কগাছ। আর যদি সব নির্যাতিতাই অভিযোগ করতো, অত্যাচারীর মুখোশ খুলে দিত তাহলে তো এই চিত্র হতো আরো ভয়াবহ। এসব ঘটনার বেশি আবার ঘটছে কোচিং সেন্টারে। কারণ সেখানে সেই শিক্ষক নামধারী শয়তান নিজের এই নোংরা পরিবেশ তৈরি করতে সমর্থ হয়! সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেন না। মানুষের রক্ত পরীক্ষা করলে সে নেশাগ্রস্থ কিনা তা জানা যায়। কিন্তু এমন কোনো পরীক্ষা নেই যে নিয়োগকৃত শিক্ষক মানুষ কিনা। এরকম ব্যবস্থা থাকলে বেশ ভালোই হতো। অন্তত কোনো নরপিশাচকে শিক্ষকতার মতো পবিত্র কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া হতো না। আমাদের দেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ শিক্ষক কর্মরত। প্রাথমিক শ্রেণিতেই কর্মরত রয়েছে কয়েক লাখ শিক্ষক। এরপর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও প্রচুর শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। সত্যি কথা বলতে আমাদের দেশে আজও শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসানো হয়। আজও শিক্ষকরা মানে মা বাবার পরের অবস্থানে। শিক্ষক-শিক্ষিকা হয়তো বাবা-মা নন, তবে বাবা-মায়ের মতো বা বাবা-মায়ের থেকেও বেশি কিছু। তো সেই শিক্ষক একজন ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করবে তা হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অথবা কোচিং সেন্টারে অথবা প্রাইভেটে সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন ছাত্রছাত্রী সমাজের আর দশটি মানুষকে বিশ্বাস না করলেও শিক্ষকের কাছ থেকে নিরাপত্তা ঠিকই আশা করে। সেখানে চিড় ধরলে তা ফিরিয়ে আনা কষ্টসাধ্যই বটে।

শিক্ষক যত দরিদ্রই হোক না কেন জ্ঞানের দিক থেকে তিনি দরিদ্র নন। এই বিশ্বাসটা আজও আমাদের দেশের মানুষের ভেতর রয়েছে। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে সেই বিশ^াসে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। শিক্ষকদের নৈতিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ আজ কাঠগড়ায়। একেবারে প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই শিক্ষকদের মাধ্যমে মেয়ে শিশুরা শারিরীক নির্যাতনের খবর এমনিক ধর্ষণের খবর পর্যন্ত পত্রিকায় দেখতে পাই। যদিও এই সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। কিন্তু এই স্বল্প সংখ্যক ঘটনাই মানুষের মনে দাগ ফেলছে। এখন তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগ। ফলে ঘরে বসেই জানতে পারছি দেশের কোনো এক প্রান্তে কোনো অমানুষ শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো মেয়ে শিশু হাসপাতালের ভর্তি। অথচ প্রাথমিকের বা মাধ্যমিকের বা কলেজের একটি ছাত্রী তার মা বাবার থেকে ভিন্ন কিছু চোখে দেখে না সেই শিক্ষককে। সেই শিক্ষক যখন তার সঙ্গে নোংরা আচরণ করে তখন কেবল শিক্ষক সমাজের ওপর কলংক লেপনই হয় না বরং সেই ছোট মেয়েটির মনের ওপর এত বিরূপ প্রভাব ফেলে যে ভবিষ্যতেও সে কোনো শিক্ষককে বিশ্বাস নাও করতে পারে। অথচ সবাই কিন্তু খারাপ না। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে হরহামেশাই এসব বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। এর খুব কম সংখ্যক ঘটনায় বাইরে প্রকাশিত হয়। কারণ ভয় ও সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই হয়তো এসব ঘটনা প্রথমেই নির্যাতিতা সামনে আনতে চায় না। যদিও তা সামনে আনাই উচিত। একটি মুখোশ খুলে দিলে তো আরো কেউ একই ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে।

কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে ২০০৯ সালের ১৪ মে আদালত নির্দেশনা দেন। নির্দেশনায় বলা হয়, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করতে হবে। এর প্রধান হবেন একজন নারী। ওই কমিটিতে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন। এর মেয়াদ হবে দুই বছর। প্রতিবছর কমিটি দুবার সভা করবে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অভিযোগ কেন্দ্র থাকবে। পাঁচ সদস্যের কমিটি ওই কেন্দ্র পরিচালনা করবে। কমিটি যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বলবে। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা বুঝে বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনে সর্বশেষ মাউশি অধিদফতর ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। কিছু সংখ্যক ক্ষেত্রে এ ধরনের শিক্ষকের ঘটনা মা বাবার কাছে মেয়েটি জানায়। তবে মা বাবাও সম্মানের ভয়ে ঘটনাটি চাপা দিয়ে যায়। কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দোষের ভাগটা মেয়েদের দিকেই বেশি থাকে।

খুব অল্প সংখ্যক মেয়ের ঘটনা প্রকাশিত হয় এবং তা মেয়েটির ও তার পরিবারের সদস্যদের সাহসিকতায়। এখন এই ধরেনর মানুষকে কি আদৌ শিক্ষক বলা যায়। শিক্ষক তো আর শুধু তার চাকরিতে হয় না। যেমন কেবল জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়ার দাবী করা যায় না, অনেকটা সেরকম। এরা নিজেদের শিক্ষক বলে দাবি করতে পারেন না। যখন একজন শিক্ষক তার অবস্থান থেকে সরে এসে নোংরামি করেন তখন তাকে আর শিক্ষক বলা যায় না। একজন যৌন নির্যাতনকারী, একজন ধর্ষক কখনো শিক্ষক হতে পারেন না। বুঝতে হবে শিক্ষকতাকে সে একটি খোলস হিসেবে নিয়েছে। যার আড়ালে থেকে সে এসব অপকর্ম নির্বিঘ্নে করতে চেয়েছে। এখন একজন খারাপ শিক্ষকের জন্য বাকি শিক্ষকদের দোষারূপ করা যায় না। কিন্তু এধরনের ঘটনা অভিভাবকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে। নিজের সন্তানকে নিয়ে এরা চিন্তিত। কারণ বর্তমান সময়ে দিনের অধিকাংশ সময়েই বাইরে লেখাপড়ার জন্য অবস্থান করতে হয়। সেক্ষেত্রে সে কোনো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকে। তার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব থাকে সেই শিক্ষকের ওপর। শিক্ষকের দ্বারা যখন একটি শিশু ধর্ষণের মতো চূড়ান্ত নোংরামির শিকার হয় তখন ভরসার জায়গাটুকু আর থাকে না। এই ঘটনার পরে অভিভাবকরা নিশ্চিতভাবে চিন্তিত এবং তাদের উদ্বিগ্নতার যথেষ্ট কারণও আছে। যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে তাদের একথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে এই পেশা আর দশটা পেশা থেকে আলাদা। এই পেশার ব্যক্তিত্ব অন্য পেশা থেকে আলাদা হতে হবে। নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন তা সত্যিকারের অভিভাবকের সমতুল্য হয়ে ওঠে। শিক্ষকরা যদি পথভ্রষ্ট হন তাহলে পুরো জাতিই পথভ্রষ্ট হবেন। একজন দুজনের জন্য অবশ্যই পুরো শিক্ষকজাতি দুর্নাম কুড়াবে না। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ হোক এবং নিরাপদ হোক শিক্ষক প্রত্যেক মেয়ের জন্য। সেই সঙ্গে শিক্ষকরা হয়ে উঠুক প্রকৃত অভিভাবক। যে অভিভাবকত্বের দাবী আমরা করছি সেই দাবী সত্যি করার দায়িত্বও আমাদের।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।