ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


রোজগার্ডেন থেকে গণভবন


২৩ জুন ২০২৩ ১৬:৩১

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন এবং বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস। এ রাজনৈতিক দলটি এ দেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলটির নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন, বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আজ ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। দলটির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অর্জন ও সাফল্য উজ্জ্বল ও গৌরবের। পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে এসেছে। স্বৈরশাসনের অবস্থান হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করে একটানা তিনবারসহ চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার বিশ্বনন্দিত নেতৃত্ব, অসীম সাহস ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল, রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি এখন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভুমিকা বরাবরই সক্রিয় এবং অগ্রগামী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, '৫৭, '৬২ ও '৬৬ সালের আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সব কিছুতেই নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর সংগ্রাম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় দলটির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাংলার মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। দেশি-বিদেশি পরাজিত শত্রুদের নীলনকশায় পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান ভাবধারা ও আদর্শে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা চালালেও ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা দেশে ফিরে সফল আন্দোলনের মাধ্যমে সে চক্রান্ত রুখে দিয়ে ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হন।

তার সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ কেবলই ইতিহাসের ধারক-বাহক হিসেবে গৌরব ও অহঙ্কারের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির গোড়াপত্তন হয় ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে পুরো পাকিস্তানজুড়ে সংগঠনটির বিস্তার ঘটিয়ে নামকরণ করা হয় “নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য এর নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের জন্মসূত্রের সঙ্গে ঢাকা ১৫০ নম্বর মোগলটুলির পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের উদ্যোগের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। ২৩ জুনের সন্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলীসহ অনেকেই। তার উদ্যোগে। ১৫০নং মোগলটুলির শওকত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে দলের ঘোষণা দেওয়া হয়। তাদের অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় এলে শওকত আলীসহ অন্য রাজনৈতিক সচেতন ও পাকিস্তান মুসলিম লীগের ওপর বিক্ষুব্ধ লোকজন তাকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধ ও পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। এ সময় প্রথম দিকে কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক। কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ এবং পরবর্তীতে কলকাতা ফেরত শেখ মুজিবুর রহমান কর্মী শিবির কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় যুক্ত হন।

বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের। অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন ১৯৪৯ সালে। আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় এলে তার সঙ্গে শওকত আলীসহ অন্যদের আলোচনা হয়। তারা মওলানাকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এসময় মওলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছিলেন। তাদের প্রাথমিক আলোচনা সেখানেই হয়। আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সবাই।

এই অনুভূতি ও তাগিদ থেকেই ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মওলানা ভাসানী সেই বৈঠকে যোগদান করেন। এ সময় খোন্দকার আবদুল হামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক এবং খন্দকার মুশতাক আহমদকে দপ্তর সম্পাদক করে অন্যদেরসহ একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক; কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। উপরোক্ত সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।

প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন টাঙ্গাইলের মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

এ সময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি নির্বাচিত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ জুন বিকেলে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্যে জনসভা করে। সভায় আনুমানিক প্রায় চার হাজার লোক উপস্থিত হয়। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার মুকুল প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ। মুজিব। উল্লেখ্য যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভােট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

তবে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে এই রাজনৈতিক দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। তখন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সরকারে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েকটি সামরিক চুক্তি হয়। সিয়াটো এবং সেন্টো সামরিক জোটে পাকিস্তান সদস্য ছিল। মওলানা ভাসানী এবং দলের মধ্যে থাকা বামপন্থীরা চাপ দিচ্ছিলেন যাতে আওয়ামী লীগ মার্কিন সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসে। সোহরাওয়ার্দীকে মার্কিন চুক্তির সমর্থক বলে মনে করা হতো। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করছিলেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। ওই বিরোধের একটা পর্যায়ে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে দলের যে। সম্মেলন হয়, সেখানে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি ভােটাভুটিতে হেরে যায়। এরপর ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে। পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। সেই বছর ২৫ জুলাই তিনি ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে অনেক নেতা তার নতুন দলে যোগ দেন, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ার মোহাম্মদ খানও। তখন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিক সংগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ আরো কিছু ছাত্র সংগঠন এক সাথে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসুচী পেশ করেন যা মুলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে হিসেবে সহায়তা করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন করে অভূতপূর্ব। সাফল্য লাভ করে। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের। একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে; কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও শোষণের ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

শুণ্য হাতে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ক্ষমতায় বসে মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছিল, তখনই দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারিরা ষড়যন্ত্র করে স্বপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭৫ সালের জুন পরবর্তী সময়) দেশ যখন দেশের অর্ভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতার দিকে যাচ্ছেন, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে যখন আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি করছেন, যখন রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভাট সষ্কার করে সমগ্র দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার  উন্নয়ন সাধন করেছেন, যখস প্রায় সমগ্র বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক সেই মুহুর্তটিকেই বেছে নেয় ঘাতক চক্র। তার দীর্ঘ ২১ বছর দেশ পরিচালিত হতে থাকে পাকিস্তানী আদর্শ ও ভাবধারায়। স্বাধীনতার শত্রু, জামায়াত-রাজাকারদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পূনর্বাসন করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ও আদর্শকে নির্বাসিত করে সামরিক কায়দায় চলতে থাকে দেশ। স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ও পরিচালিত জেনারেল জিয়াউর রহমানের সমগ্র শাসনকাল ছিল প্রকারন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী একটি কালো অধ্যায়। এই সময়েই জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের নির্বিগ্নে দেশ থেকে বিদেশে পাঠিয়ে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে পূনর্বাসিক করা হয়। সব জায়গা থেকে মুছে ফেরার চেষ্টা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তি যুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর অবদানকে। একই ভাবধারায় জিয়া হত্যার পর ক্ষমতায় এসে দেশ চালাতে থাকে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শুন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এর পর দলের মধ্যে ভাঙনও দেখা দেয়। স্বৈরশাসনের যাতাকলে আওয়ামী লীগ যখন বহুধাবিভক্ত, আশাহত, নির্যাতিত এবং কান্ডারীবিহীন নৌকার মত খাবি খাচ্ছে, ঠিক সেই মুহুর্তে ১৯৮১ সালের ১৭ মে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু কণ্যা পিতৃ-মাতৃহীন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। চার দশক ধরে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে দলটি। তাঁর অপরীসীম ধৈর্য, সাহস, ত্যাগ ও অটুঁট আদর্শের উপর ভিত্তি করে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে পিতার সৃষ্ট উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্বে দিয়ে দলকে করেছেন সুসংহত, সংঘবদ্ধ ও আদর্শবান। পূনরায় দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।    

     

আওয়ামী লীগের জন্মের ৭৪ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা সুসংহত হতে সক্ষম হয়ে জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনে সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিল দলটি। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে আবারো নতুন সংকটের মুখে পড়ে যায় দলটি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির অসংখ্য নেতারা গ্রেফতার এবং একাংশের সংস্কার তৎপরতায় কিছুটা সংকটে পড়ে দলীয় কার্যক্রম। তবে, সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হন। নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সুখী, সমৃদ্ধ ‘ডিজটাল বাংলাদেশ’ গড়াসহ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে গেছে দলটি।  

এবার ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন। এবার সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তর। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট এ চারটি মূল ভিত্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলাদেশ বুলেটিন