মহামারী ও মহাদুর্যোগ প্রকৃতির প্রতিশোধ

মহামারী, মহাদুর্যোগ কখনো বলে-কয়ে আসে না, আচমকাই আঘাত হানে। এখানেই প্রকৃতির রহস্য; যে রহস্য বিজ্ঞান এখনো উন্মোচন করতে সক্ষম হয়নি। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে কিছু কিছু দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও মহামারী অথবা অতিমারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি আজ অবধি। অথবা সে ধরনের কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি পূর্বাভাস দেওয়ার মতো। আবহাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও ভূমিকম্প-সুনামি কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাত সম্পর্কে ততোধিক নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। তার পরেও বিজ্ঞানের কল্যাণে ভূমিকম্প কিংবা সুনামি অথবা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামান্য তথ্য জানাতে পারেন মানুষ। কিন্তু মহামারী অথবা অতিমারীর ক্ষেত্রে সে ধরনের তথ্য প্রদান করে আজ অবধি মানুষকে সহযোগিতা করতে পারেনি বিজ্ঞান। ভাবা যায়, এক্ষেত্রে কতটা অসহায় বিজ্ঞান! হয়তো চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মহামারীর প্রতিষেধক অথবা ভ্যাকসিন বানাতে সক্ষম হয়েছেন মানুষ, কিন্তু ততদিনে লাখ লাখ প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে গেছে বিশ্বে। মোটের ওপর মহামারীর ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেওয়া যায় না; মহামারীর ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে, পাশের দেশ অথবা পাশের গ্রামের মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে, এখন নিজ দেশ অথবা নিজ গ্রামেও সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মহামারী সংক্রমিত হবে এতদিনের মধ্যেই, সে ধরনের কোনো তথ্য প্রদান করার ক্ষমতা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ মানুষ চন্দ্র বিজয় করেছেন, মহাশূন্যে টমেটো চাষ করে খাচ্ছেন, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়ানোর পাঁয়তারা করছেন, সমুদ্রের তলদেশ থেকে নুড়িপাথর কুড়িয়ে আনছেন। আরো কত কী যে মানুষ করেছেন, তার হিসাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধ করি। সেই হিসাব দাখিল করলে লেখার প্রসঙ্গটাও ব্যাহত হতে পারে। তাই আপাতত সেদিকে না গিয়ে মূল আলোচনায় যাচ্ছি আমরা।
আমরা মহামারীর কথা বলছি; বলছি একটি ক্ষুদ্র জীবাণুর কথা, একটি ভাইরাসের কথা। যাকে পিষে ফেলতে হলে (যদি চোখে দেখা যেত) প্রয়োজন হতো না একদিন বয়সের একটি শিশুর শক্তিও। অথচ শক্তিতে এতটাই দুর্বল একটি জীবাণু মানুষকে মুহূর্তেই ঘায়েল করে ছাড়ছে। বিশ্ববাসীকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী থেকে শুরু করে দরিদ্র মানুষটাকেও পরাস্ত করছে; ঘটাচ্ছে প্রাণের বিনাশও। সেই অসহায় একটি ভাইরাসের শক্তির কাছে বিশ্ববাসী আজ পরাজিত হয়ে পড়েছেন। যে ভাইরাসটি ১৯৬০ দশকেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, তারই একটি প্রজাতি কোভিড-১৯, যা ২০১৯ সালে চীনে শনাক্ত হয়েছে পুনরায়। উক্ত কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসটি বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে মৃতের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছেও। এ সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভ্যাকসিন নিলেও যে সম্পূর্ণ নিরাপদ তাও কিন্তু বলা যাচ্ছে না; তা ছাড়া ভ্যাকসিন গ্রহণকারী সর্বোচ্চ এক বছরের সুরক্ষা পাবেন, এমনটিই জেনে আসছি আমরা। অর্থাৎ অনিশ্চিত এক জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে পার করতে হবে আমাদেরকে।
বিশ্ব মহামারী ২০১৯ সালেই প্রথম নয়; শত শত বছর আগেও বিশ্বে দফায় দফায় মহামারী হানা দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি প্রাণ। কত সভ্যতাকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। চলমান বিশ্ব মহামারীর আগে সর্বশেষ আমাদের দেশে হানা দিয়েছিল গুটিবসন্ত ও কলেরা। সেসব থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে। ততদিনে দেশে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। আবার দেখা গেছে, গুটিবসন্ত আক্রান্তের পরেও বেঁচে থাকা কিছু মানুষের মুখে বড় বড় গর্ত বা দাগ রয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ অন্ধত্ব বরণ করেও দিনাতিপাত করছেন। সেই ভয়ংকর ভাইরাসেরও বিনাশ ঘটেছে। মানুষের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের কাছেই পরাজিত হয়েছে গুটিবসন্ত ও কলেরা। তদ্রূপ করোনা ভাইরাসও একদিন সম্পূর্ণ পরাজিত হবে বিজ্ঞানের কাছে। সেদিন হয়তো খুব বেশিদূর নয়, ততদিনে বহুসংখ্যক প্রাণহানি ঘটে যাবে বিশ্বে, আর সেটিই হবে তখন আমাদের জন্য বড় ধরনের আফসোস। তবু আমরা বলতে পারি ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে কিছুটা সুরক্ষা পাব। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
শুরুতেই আমরা বলেছি যে, বিশ্ব মহামারী বলে-কয়ে আসে না, এটি প্রকৃতি প্রদত্ত। শুধু তা-ই নয়, আমরা বলব এটি প্রকৃতির প্রতিশোধও বটে। আমরা নানান কারণে প্রকৃতির ওপর জোরজুলুম অব্যাহত রেখেছি। অপ্রয়োজনে প্রকৃতিকে খুন করছি; প্রকৃতিকে জব্দ করছি অকারণে। যার ফলে আজ নিজেরাই জব্দ হয়ে পড়েছি প্রকৃতির কাছে। অথচ সেই অংকের যোগফল মিলাতেও ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, একটি জীবাণু বা ভাইরাস এমনি এমনি উৎপত্তি হয়নি কিংবা মানুষের মাঝে নিজ থেকেই ছড়িয়ে পড়েনি। এর জন্য ভাইরাস কোনোভাবে দায়ী নয়; দায়ী হচ্ছে মানুষ। দুইভাবে দায়ী মানুষ। যেমন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কথা ধরা যাক আগে। আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালিপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং চলমান তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার জন্য নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। এভাবেই নতুন নতুন জীবাণুর উৎপত্তি ঘটছে। অপরদিকে টিকে থাকতে না পারা প্রাণিকুল চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন হারিয়েছিল ডাইনোসর; একইভাবে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটাও বৈচিত্র্যের কিছু নয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় আমাদের প্রিয় গ্রহ বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে এমনিই, তখন জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে আমাদের বেঁচে থাকার স্বাদ মিটে যাবে মুহূর্তেই। কারণ তখন নতুন জীবাণু বা প্রাণিকুলেরই বিশ্বময় দাপট থাকবে; সেখানে আমরা অসহায় হয়ে পড়ব। তখন আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।
এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, নতুন জীবানু উৎপত্তি হলেও আমাদের মধ্যে কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ছে? আসলে ব্যাপারটি তত জটিল নয়, খুবই সোজা হিসাব। যতটা জানা যায়, এসব জীবাণু প্রথমে সংক্রমিত হয় বন্যপ্রাণীদের শরীরে। সেখান থেকে খুব সহজেই মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেটি হচ্ছে, অবাধে বন্যপ্রাণী নিধনের কারণে। তার প্রমাণও আমরা বার কয়েক পেয়েছি। বার্ডফ্লু, ইবোলা ভাইরাস, প্লেগ, নিপা ভাইরাসসহ আরো অনেক ভাইরাস দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হয়েছে বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে। বলে রাখা ভালো, এসব বন্যপ্রাণী দৌড়ে এসে আমাদের গায়ে ভাইরাস ছিটিয়ে যায়নি, বরং আমরাই ওদের কাছে গিয়েছি, বিভিন্নভাবে বিরক্ত করছি অথবা বন্যপ্রাণী নিধন করে খাবারের তালিকায় নিয়ে এসেছি। ফলে ভাইরাস অতিসহজে সংক্রমিত হতে পেরেছে আমাদের শরীরে। সর্বশেষ করোনা সম্পর্কেও এমনটি ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবাদমাধ্যমেও জানা গেছে, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে বন্যপ্রাণীর বড় পরিসরের বাজার রয়েছে। যেখানে নানান ধরনের বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে দেদার। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বাজারে চোরাপথে আসা বনরুই অথবা বাদুড় থেকে করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে। পরে যা সমগ্র বিশ্বে পর্যায়ক্রমে ছড়িয়েও পড়েছে। সেই ধারণাটি একেবারেই অমূলক নয়। কারণ চীনদেশের অধিকাংশ মানুষ অর্ধসিদ্ধ খাবার খেতে পছন্দ করেন, আবার কেউ কেউ কাঁচাও খেয়ে থাকেন। এসব আমরা ইউটিউব মারফত দেখতে পাচ্ছিও। সেই ভিডিও দেখে উপলব্ধি করা যায়, যে-কোনো ভাইরাস খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারে মানবদেহে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কি আমরা বলতে পারি না যে এটি হচ্ছে অবাধে বন্যপ্রাণী নিধনের ফলাফল? যে ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতি আমাদের ওপর রুষ্ট হয়েছে! যার কারণ রিসাইকেলের মতো আমরা নিজেরাই সেই শিকারে পরিণত হচ্ছি! সুতরাং আমাদের বেঁচে থাকতে হলে অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার করা এবং শিকারে পরিণত হওয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নচেত সমগ্র মানবজাতিকে চিরতরে গ্রহ থেকে বিতাড়িত হতে হবে অচিরেই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক লেখক