ঢাকা শনিবার, ১৭ই মে ২০২৫, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


৫০-৬০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গাদের এনআইডি বানিয়ে দিতেন তারা


১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৩৩

নতুন সময়

চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের এক অফিস সহায়কসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গাদের ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ (এনআইডি) দেয়ার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসার পল্লবী চাকমা বাদী হয়ে মঙ্গলবার কোতোয়ালি থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে নির্বাচন অফিস থেকে ৫ বছর আগে ২০১৪ সালে গায়েব হওয়া একটি ল্যাপটপ ও ৪টি মোবাইল সেট।

মামলার আসামিরা হলেন ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন (৩৪), তার দুই সহযোগী গাড়িচালক বিজয় দাশ (২৮) ও তার বোন সীমা দাশ ওরফে সুমাইয়া জাহান (৩২) অপর দু'জন সাগর (৩৭) ও সত্য সুন্দর দে (৩৮)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিজয় গাড়িচালক এবং সীমা চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালে অস্থায়ী ভিত্তিতে আয়া পদে কর্মরত আছেন।

মামলার ৫ আসামির মধ্যে ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদিন, গাড়িচালক বিজয় দাশ ও তার বোন সীমা দাশ ওরফে সুমাইয়া আক্তারকে আটক করে সোমবার রাতে কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।

গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তারা বলেছেন, ল্যাপটপ ও নিজের মোবাইলে জয়নাল জাতীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয় তৈরি করে সরবরাহ করতেন। বাকি আসামিদের সহায়তায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে রোহিঙ্গাদের ভোটার করান বলে অভিযোগ করা হয়।

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নির্বাচন কমিশন আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মামলার ৫ আসামির মধ্যে তিনজন গ্রেফতার আছেন। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

চট্টগ্রাম কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করবে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিইউ)। ইতিমধ্যে মামলার নথিপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। সিটিইউ’র পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়াকে এ মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে।’ আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল আবেদীন স্বীকার করেন, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ডবলমুরিং থানা নির্বচন অফিসে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করাকালীন ঢাকা থেকে সাগরের মাধ্যমে ঢাকা নির্বাচন অফিস থেকে ল্যাপটপ সংগ্রহ করেন। ল্যাপটপ ও নিজের মোবাইলে জয়নাল জাতীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয় তৈরি করে সরবরাহ করেন।

মামলায় ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে ডবলমুরিং নির্বাচন কার্যালয় ও কোতোয়ালি থানার আমেনা মঞ্জিল সাবএরিয়া মাজারের সামনে ষষ্ঠ তলার ডান পাশের ফ্ল্যাট।

এ ছাড়াও জয়নাল বাকি আসামিদের সহায়তায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন।

জয়নাল জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানান, চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিস থেকে ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড গোপনে নিয়ে প্রতি শুক্রবার ও শনিবারসহ বন্ধের দিনগুলোতে নিজ বাসায় বসে অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্রের যাবতীয় ডাটা ক্রিয়েট সম্পন্ন করে মেইলে ঢাকায় অবস্থানরত সাগরের কাছে পাঠাতেন। সাগর জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে আপলোডসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রিন্ট কপি এসএ পরিবহনের মাধ্যমে জয়নালের কাছে পাঠাতেন। এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী ও চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসার পল্লবী চাকমা যুগান্তরকে বলেন, ‘আটকের পর জয়নালের দেয়া তথ্যে ২০১৪ সালে নির্বাচন অফিস থেকে চুরি হওয়া একটি ল্যাপটপ তার বন্ধু বিজয় দাশ ও তার বোন সীমার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। এ কারণে তাদের আটক করা হয়। তার সহযোগী হিসেবে সাগর ও সত্য সুন্দর দের কথা উল্লেখ করেছেন। মামলায় তাদেরও আসামি করা হয়। তবে সাগর ও সত্য সুন্দর দে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। আশা করছি মামলার তদন্তে তাদের পরিচয় ও ভূমিকা উঠে আসবে।’

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান জানান, সম্প্রতি কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সময় এক দালালসহ সাতজনকে আটক করা হয়। চট্টগ্রামে কর্মরত জয়নাল আবেদীনের সহায়তায় তারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। তাদের দেয়া তথ্যে পরে নির্বাচন কমিশনের একটি দল জয়নালকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে।

এ সময় জয়নাল তার কাছে একটি ল্যাপটপ থাকার কথা স্বীকার করেন এবং তা তার বন্ধু বিজয়ের কাছে ওই ল্যাপটপ আছে বলে জানান। এরপর বিজয়কে সোমবার রাতে কৌশলে চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। তিনি জানান ল্যাপটপটি তার বোন সীমার কাছে আছে। সীমা ল্যাপটপটি নিয়ে রাতে নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এলে তাদের তিনজনকে আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

লাকী নামের এক নারী গত ১৮ আগস্ট স্মার্ট কার্ড তুলতে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে তার হাতে পুরনো এনআইডিতে ১৭ ডিজিটের নম্বর দেখে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জেরার মুখে লাকী নিজের প্রকৃত নাম রমজান বিবি এবং ২০১৪ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পর টেকনাফের মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিলেন বলে স্বীকার করেন।

ওই রোহিঙ্গা নারী ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তৈরি করিয়েছেন ওই জাল এনআইডি। অথচ ওই ভুয়া পরিচয়পত্রের তথ্যও নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে।

এই ঘটনার পর নির্বাচন কমিশন থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি তদন্তে নেমে নির্বাচন অফিসের কারও যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটছে বলে তথ্য পায়। এরপর নির্বাচন কমিশনের আরেকটি বিশেষ টিম তিনদিন কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে এক দালালসহ সাতজনকে আটক করে।