নতুন দল গড়ছে জামায়াতের সংস্কারপন্থী নেতারা

জামায়াতের সংস্কার দাবি করা নেতারা নতুন দল গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রস্তুতিও নেয়া হয়ে গেছে। শিগ্রই নতুন দল গড়ার উদ্যোগ আলোর মুখ দেখবে বলে দলটির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
আগামীকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে কিংবা অন্য একটি মিলনায়তনে দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হতে পারে। পরে দলের গঠনতন্ত্র, ইশতেহার চূড়ান্ত করে তিন মাসের মধ্যে রাজনীতিতে সোচ্চার হওয়ার পরিকল্পনা তাদের। তবে এ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িতরা দল গঠনের বিষয়টি স্বীকার করতে চাইছেন না। তারা এটি নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ বলে অভিহিত করতে চাইছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন দলের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ দলে যারা থাকছেন তারা সবাই বয়সে তরুণ ও শিবিরের সাবেক নেতা। মূলত একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের লোকজনকে নিয়ে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। শিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত মজিবুর রহমান মঞ্জু দল গঠনে সমন্বয়কের ভূমিকায় রয়েছেন। ঠিক কারা এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত তা নিয়ে এখনই মুখ খুলতে চাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নতুন উদ্যোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনই তারা সরাসরি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেবেন না। নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগে ইসলাম বা ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোকে অনুসরণ করা হবে না। সাম্য ও মানবাধিকারকে বেশি গুরুত্ব দেবেন তারা।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আপাতত এই প্রক্রিয়ায় সামনে থাকছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতা মজিবুর রহমান (মঞ্জু)। তিনি একসময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং পরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। এই উদ্যোগের সঙ্গে পরে সরাসরি যুক্ত হবেন জামায়াত ত্যাগ করা দলটির সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তিনি বর্তমানে লন্ডনে বসে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
আগামীকাল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। এ লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকার একটি মিলনায়তন ঠিক করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অতিথি বা পর্যবেক্ষক হিসেবে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি।
আগামী ২৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এ উদ্যোগের বিষয়ে ঘোষণা দেয়া হবে। সেখানে কেন আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করব, কারা থাকবেন- এসব নিয়ে বিস্তারিত জানাব। এরপরই মূলত নতুন দলের নাম, গঠনতন্ত্র, ইশতেহার নিয়ে আমরা কাজ শুরু করব।
তিনি বলেন, আমি নিজে যেহেতু শিবিরের সভাপতি ছিলাম, সে হিসেবে শিবিরের অনেকেই এর সঙ্গে থাকতে পারেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এতে সম্পৃক্ত হবেন।
সংস্কারপন্থীদের নতুন দল গঠন নিয়ে চাপ ও উদ্বেগে ফেলেছে জামায়াতের মূল নেতৃত্বকে। ইতিমধ্যে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছে শীর্ষ নেতৃত্ব। জানা গেছে, এ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন নীতিনির্ধারকরা।
সংস্কারপন্থী নেতারা জানান, দলের কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা যাতে নতুন দল গড়ার উদ্যোগে অংশ না নেন, সে জন্য কড়া নজরদারির পাশাপাশি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলের জামায়াত ও শিবিরের অন্তত অর্ধশত নেতা ও সদস্যকে ডেকে আলাদাভাবে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ডেকে নেয়া নেতাদের কাউকে কাউকে শাসানো হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব নেতাদের কেউ কেউ সংস্কারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারপন্থীদের রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ ঠেকাতে দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান মালয়েশিয়া হয়ে এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। দেশ দুটিতে জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থক আছেন, যাদের একটি বড় অংশ জামায়াতের সংস্কার চায়। মালয়েশিয়ায় শফিকুর রহমান একাধিক ঘরোয়া সাংগঠনিক বৈঠক করে সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে নেতিবাচক বক্তব্য দেন। এখন তিনি লন্ডনে। জামায়াত থেকে সদ্য পদত্যাগী নেতা আবদুর রাজ্জাক আগে থেকেই লন্ডনে আছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার যাওয়ার আগে শফিকুর রহমান সৌদি আরবও সফর করেন। সেখানেও তিনি সংগঠনের প্রবাসী দায়িত্বশীলদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে সতর্ক করেন। শফিকুর রহমান সৌদি আরব থেকে ফিরে আসার পর দেশটি সফরে যান সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত নেতা শাহজাহান চৌধুরী। তাকে অনেক দিন ধরেই দলে কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ আছে।
তবে এসব নিয়ে জামায়াতের কোনো নেতা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। কেন্দ্রীয় নায়েবে আমিরকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে গত ১১ এপ্রিল লন্ডনের ওসবর্নে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের আইন পেশার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এন ইভিনিং উইথ ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক শিরোনামে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি নিজে কোনো দল করছি না। কিন্তু বাংলাদেশে একটি সুস্থ রাজনীতির ধারা গড়ে উঠুক- এটা আমি চাই। কেউ যদি এমন রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, নাগরিক হিসেবে তাদের প্রতি আমার সমর্থন থাকবে। তবে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।
জামায়াতে সংস্কার এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনকারী ব্যারিস্টার রাজ্জাক। কয়েক বছর ধরে তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক জামায়াত বিলুপ্ত করে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের আমীর মকবুল আহমাদকে। রাজ্জাকের পদত্যাগের দিনই জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু। যিনি দলের মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন।
তিনিও একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে উদারপন্থী দল গঠনের পক্ষে ছিলেন। জামায়াতের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন মঞ্জু। অনেক নেতাকর্মী তার মতের সমর্থক মনে করা হলেও নতুন দলে আবদুর রাজ্জাক থাকবেন কি না, তা পরিষ্কার করেননি মঞ্জু। তিনি বলেন, আমরা ব্যারিস্টার রাজ্জাককে ‘অ্যাপ্রোচ’ করিনি। তার কাছ থেকে আমরা পরামর্শ নিতে পারি। যেহেতু তিনি বিজ্ঞ।
নতুনসময়/এনএইচ