লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট ইতিবাচক হিসাবে দেখছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল, এপ্রিল থেকে নির্বাচন

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দিনক্ষণ সব চূড়ান্ত। একজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, অপরজন দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির কান্ডারি। নির্বাচন হলে জনগণের ভোটে যে দলটির সরকার গঠন করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আবার যে দলটি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করতে চায়। সঙ্গত কারণে এ বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বৈঠকের খবরটি নিশ্চিতভাবে ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করে। বিশেষ করে যখন নির্বাচনের সময় নির্ধারণসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি ও গুমোট পরিস্থিতি ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখন ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের আসন্ন বৈঠককে দেশের জন্য শুভসংবাদ বলে অভিহিত করেছেন অনেকে।
এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠকটিকে রীতিমতো টার্নিং পয়েন্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর সঙ্গে তিনি কতগুলো বিশেষণ যুক্ত করে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হতে পারে। সমাধান হয়ে যেতে পারে বিদ্যমান অনেক সমস্যার।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলও এ বৈঠকটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন। তাদের মতে, রাজনীতি খুবই কঠিন নীতি। এখানে সবাই মুখে নীতিকথা বললেও আড়ালে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক চলে। ফলে এ মুহূর্তে মাঠের বড় খেলোয়াড় বিএনপি হলেও গণ-অভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনমুখী অনেক দলই নানাভাবে ক্ষমতার স্বাদ নিতে চায়। বিএনপি মুখে যতই বলুক, ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার করবে-তথাপি সবাই ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ নানা লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলিয়ে নিতে ব্যস্ত। এসব কারণে রাজনীতির অন্দরমহল বেশ গরম। তারা মনে করেন, খোলা চোখে রাজনীতিতে যা আমরা দেখছি-এটাই আসল দেখা নয়। পুরো চেহারাটা দেখতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। এছাড়া ভূরাজনীতির নানা স্বার্থের খেলার মধ্যে রাজনীতি সরলরেখায় চলতে পারছে না। বিপদ বুঝে বারবার গতিপথ পালটাতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রাপথও সরলরেখায় এগোতে পারছে না। তবে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক ম্যাচ খেলার মধ্যে ‘শেষ বল’ বলে কিছু না থাকলেও লন্ডন বৈঠকের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংকটের আপাতত একটা সমাধান মিলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি এই ধরনের বৈঠক আরও আগেই হতে পারত। এখন যে বৈঠকটা হচ্ছে এটা মূলত আমরা বুঝতেই পারছি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে হবে। এখন কিন্তু বিএনপি এবং সরকার মুখোমুখি অবস্থানে আছে। বিএনপি বলেছে তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় এবং ড. ইউনূস বলেছেন এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন দেবেন। এখন এই দুই জায়গায় কিন্তু বিরোধপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। তাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে এই বৈঠকটা করলে ভালো হতো। তারপরও আমি বলব-এই বৈঠকের অবশ্যই ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। এটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমি মনে করি, এটা আমাদের দেশ এবং জাতির জন্য খুব ইতিবাচক। আমার প্রত্যাশা থাকবে-দুপক্ষই খুব সহনশীল হবে। একে অন্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়েই বৈঠকে বসবেন। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, দুপক্ষই কিছুটা ছাড় দেবেন। সম্ভবত এপ্রিল এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে নির্বাচনের তারিখ পুনর্নির্ধারিত হবে।’ প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্য সফররত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকটি হবে ১৩ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় সকালে। বৈঠকটি হবে ২ ঘণ্টাব্যাপী।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায় না বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির প্রচার বিভাগের দায়িত্বে থাকা এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে জামায়াত কোনো মন্তব্য করবে না।
জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন গেছেন। উনি সময় করতে পেরেছেন, তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তা না জানা পর্যন্ত মন্তব্য করতে পারছি না। তবে দেশ একটা সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং এই দুই ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আলোচনায় একটা পজিটিভ কিছু আসবে এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আশা করছি একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে। এখানে যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপি এবং আমরা সমর্থন করে আসছি, সেই সমর্থনের কথাটা যখন আলোচনা হবে। আবার এখন যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন, বিশেষ করে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সরকার তো রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তত বেশি বিবেচনার মধ্যে নেয়নি। আমার ধারণা এটা নিয়ে নিশ্চয়ই বৈঠকে আলাপ-আলোচনা হবে। এপ্রিল মাস কোনোভাবেই নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়, এটা যে কোনো মানুষ জানে এবং বোঝে। সেদিক থেকে নির্বাচনটা ডিসেম্বর বা ডিসেম্বরের কাছাকাছি কীভাবে এগিয়ে আনা সম্ভব সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত। আমার মনে হয়, নিশ্চয় আলোচনা হবে।
লন্ডন সফররত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সে দেশে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হওয়ার বিষয়টিকে একটি গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ বলে মনে করে জুলাই বিপ্লবের পটভূমিতে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। যে কোনো দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনা হতেই পারে। এটি গণতান্ত্রিক চর্চারই অংশ। তবে এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে যেন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নতুন করে বাড়তি চাপ তৈরি না হয়। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে উভয়ের মধ্যে যে আলোচনা হবে সেটা যেন শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বিচার এবং সংস্কারের বিষয়টি যেন সমান গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মধ্যে আলোচনা হওয়া খবুই জরুরি। বিএনপি অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার। তার প্রধান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক কিংবা তিনি (তারেক রহমান) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এটা ইতিবাচক ঘটনা। আমরা আশা করি, রাজনৈতিকভাবে নানা দিক থেকে আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। সেটার অগ্রগতি হবে।’
এ প্রসঙ্গে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও অযথা বিভেদে দেশের কোনো কল্যাণ নেই। বাংলাদেশের যে কোনো অকল্যাণে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয় সীমান্তের ওপারের আগ্রাসী শক্তি ও তাদের আশ্রিত পলাতক-পরাজিত স্বৈরাচার। তাই এবি পার্টি সব সময় সমঝোতা ও স্যাক্রিফাইসের কথা বলে এসেছে। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্ভাব?্য বৈঠক সফল হোক। দেশের জন্য এ বৈঠক কল্যাণকর বার্তা বয়ে আনুক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘উভয়ের উদ্দেশ্য যদি ভালো থাকে, দেশের কল্যাণে যদি বৈঠক হয় সেটা ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। তবে ভিন্ন উদ্দেশ্য হলে সমস্যা হবে। তাদের উদ্দেশ্য যদি হয় দেশের রাজনৈতিক স্থিরতা তৈরি করা, রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতা পয়দা করা, দেশের স্বার্থ, জাতির স্বার্থ এসব যদি সংশ্লিষ্ট থাকে তাহলে মতবিনিময় হতেই পারে। এটা কোনো সমস্যা নয়। যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা উল্লেখ করেছেন, সেটা নড়চড় হবে বলে মনে হয় না। এই বৈঠকের মধ্যে ওটা (নির্বাচনের সময়সীমা) পরিবর্তনের সম্ভাবনা যদি থাকে, সেখানে সমস্যা হবে। বিভেদ সৃষ্টি হবে। তবে আমরা আশা করছি নির্বাচনের সময়সীমা পরিবর্তন হবে না। এখানে প্রধান উপদেষ্টা দৃঢ় থাকবেন।’