ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


সামনে মামুনুল পেছনে বিএনপি-জামায়াত


২১ এপ্রিল ২০২১ ০৭:১০

ফাইল ছবি

বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে আবারো হট ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে হেফাজত ইসলাম। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে হেফাজতের হরতালসহ নজীরবিহীন তান্ডব চালায়। সেই সময় প্রশাসন কিছুটা নিরব থাকাতে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে। সর্বশেষ হেফাজতের অন্যতম নেতা মামুনুল হক নারীসহ নারায়নগঞ্জের রিসোর্টে জনতার হাতে আটক হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সরকার কঠোর হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে মামুনুল হকসহ হেফাজতের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারের বাইরে যারা রয়েছেন তারা দৌড়ের উপর। এরই মধ্যে গ্রেফতারকৃত এক নেতা আদালতে জবানবন্দিতে শাপলা চত্বরের ঘটনার আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। আর মামুনুল হকও বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনার পেছনে বিএনপি জামায়াতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখন পরিস্কার হয়ে গেছে। আর মোদি বিরোধী ঘটনার পেছনেও এই জামায়াত বিএনপি যে কাজ করেছে সেটিরও তথ্য প্রমান চলে এসেছে। অর্থ্যাৎ হেফাজত তথা মামুনুলকে সামনে দিয়ে পেছনে কাজ করেছে জামায়াত বিএনপির নেতারা।

রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বপ্ন ছিল মামুনুলের: ডিসি হারুন

উসকানিমূলক বক্তব্য ও কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল গ্রেপ্তারকৃত হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের। রিমান্ডের প্রথম দিনে তিনি গোয়েন্দাদের জেরার মুখে এসব কথা বলেন।

মঙ্গলবার দুপুরে তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রিমান্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন।

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মামানুল হক বলেন, তার স্বপ্ন ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার। এজন্য দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের জড়ো করেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেছেন বলেও স্বীকার করেন। পরে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে তিনি সেভাবেই কাজ করছিলেন।

নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে মামুনুলের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য দিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছিলেন। এছাড়া সাদপন্থীদের মারধরের কথা স্বীকারও করেছেন। তিনি জুবায়েরপন্থীও। জোশের কারণে ওয়াজ মাহফিলের বক্তৃতায় শাহরিয়ার কবির, রাশেদ খান মেনন, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি যে মানহাকির বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন।

ডিসি হারুন বলেন, মামুনুল বিভিন্ন সময় ইউটিউব বা ফেসবুকে রাষ্ট্রবিরোধেী যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, এটি রাজনীতিক বক্তব্য। যা অনেক রাজনীতিবিদ দিয়ে থাকেন। আমি তেমনটিই করেছি। ২৫, ২৬ মার্চ সারাদেশে হেফাজতের ভাঙচুর-জ্বালাও পোড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তার প্রথম স্ত্রী, নারায়ণগঞ্জে নারী কেলেঙ্কারি, তার কতজন স্ত্রী আছে ইত্যাদি তথ্য দিয়েছেন। যেগুলো নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
৫ মে’র আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন বাবুনগরী

বাবুনগরী খালেদা বৈঠক : ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন সংগঠনটির তৎকালীন মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। সোমবার (১৯ এপ্রিল) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য জানিয়েছেন সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটির তৎকালীন প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান।

জবানবন্দিতে মুফতি ফখরুল বলেছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে’র সেই সহিংসতায় তৎকালীন বিএনপি ও জাময়াতের একাধিক শীর্ষ নেতা অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। সহিংসতায় অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও।

গত ১৪ এপ্রিল লালবাগ এলাকা থেকে মুফতি ফখরুলকে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ড শেষে সোমবার তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে যা বলেছেন :

মুফতি ফখরুল বলেছেন, তিনি কামরাঙ্গীরচর জামিয়া নূরীয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান কমিটির আগের কমিটির ঢাকা মহানগরীর প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও মারকাজুল আজিজ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত।

৫ মে’র সহিংসতার বিষয়ে বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে আমি কারাঙ্গীরচর মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার ৮-১০ হাজার হেফাজত কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে লালবাগ-চকবাজার হয়ে নয়াবাজারে আসি। জোহরের নামাজ পর্যন্ত আমরা ৮-১০ হাজার লোকসহ এখানেই ছিলাম। জোহরের নামাজ আদায়ের পর দুপুর ২টার দিকে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেব ফোন দিয়ে সবাইকে নিয়ে শাপলা চত্বরে যাওয়ার জন্য বলে।’

জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় গোলাপশাহ মাজারের (গুলিস্থান) সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তারা সেখানে ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। দুপুর ৩টার দিকে তার নেতৃত্বে ৫-৭ হাজার লোক নিয়ে তিনি শাপলা চত্বরে পৌঁছান। শাপলা চত্বরে গিয়ে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহ রব ইউসুফি, জুনায়েদ আল হাবিব, মামুনুল হক, মাওলানা জাফর উল্লাহ, আবুল হাসনাতমহ অনেককেই দেখতে পান। এর মধ্যে ৪৩ জনের নাম জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন তিনি। মামুনুল হকসহ অন্যান্য হেফাজত নেতারা তাদের ১৩ দফা দাবি আদায় না করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলন করা হবে বলে তাকে জানিয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেছেন, ‘মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী তাকে বলেছেন, আন্দোলন ও সহিংসতার বিষয়ে দু’জন বিএনপি নেতা এবং একজন জামায়াত নেতা তাদের অর্থ সহযোগীতা করছে। এছাড়া ২৮ এপ্রিল (২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল, ৫ মে’র এক সপ্তাহ আগে) গোপনে বাবুনগরীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার গোপন বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে হেফাজতের প্রোগ্রাম শাপলা চত্বরে স্থায়ী হলে বিএনপি ও জামায়াতও যোগ দেবে বলে আলোচনা হয়েছে। ওই দিন দুপুর থেকেই বিএনপি-জাময়াতের কর্মীরা রাস্তায় বাধা সৃষ্টি ও আগুন দেওয়া শুরু করে।’

২০১৩ সালের ৫ মে’র একদিন আগে ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে নেতাকর্মীদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের একটি অংশ দ্বিমত পোষণ করায় সাংগঠনিকভাবে হেফাজতের অবরোধে অংশ নিতে পারেনি বিএনপি। বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা হেফাজতের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। তবে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই হেফাজতের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল বলে জানিয়েছেন একাধক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে এক আলোচনা সভায় হেফাজতের একটি অংশ শাপলা চত্বরের ঘটনার পুরো দায় জুনায়েদ বাবুনগরীর বলে মন্তব্য করেন। শাপলা চত্বরের ঘটনার সময় বাবুনগরী হেফাজতের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। মৃত্যুর পর আহমদ শফীর ওপর এক আলোচনা সভায় হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সলিমুল্লাহ দাবি করেন, ‘২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার দায় বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর। তিনি তখন হেফাজতের মহাসচিব ছিলের। শাপলা চত্বরে রাতে অবস্থানের কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না। রাতে থাকলে সেনাবাহিনী নামবে বলে তিনি (বাবুনগরী) একক সিদ্ধান্তে রাতে অবস্থানের নির্দেশ দেন।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২০১৩ সাল থেকেই জুনায়েদ বাবুনগরী বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আহমদ শফীর জন্য আগে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর বাবুনগরীর আমীর নির্বাচিত হলে হেফাজত পুরোপুরি ‘অ্যান্টি গর্ভনমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজ’ শুরু করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে গত বছরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিরোধিতা শুরু করে চলতি বছরের মোদীবিরোধী আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বৃহৎ নাশকতার পরিকল্পনা তাদের ছিলো। হেফাজতের আড়ালে বিএনপি জামায়াতের লোকজনও তাদের সঙ্গে যোগ হতো। সবমিলিয়ে ধর্মকে ইস্যু করে মামুনুল হককে সামনে দিয়ে সরকার পতনের একটি গভীর ষড়যন্ত্র ছিলো। বর্তমানে আটক নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদে এমনটাই সামনে উঠে আসছে।

কর্মকর্তারা বলেন, মামুনুলসহ আটক নেতাকর্মীদের এখনো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে সবার নিকট প্রাপ্ত তথ্যে নিয়ে এর পেছনে কারা ছিলো তাদেরও আইনের আওতায় আনার কাজটি শুরু হবে।