ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


দৌড়াচ্ছেন হেফাজত নেতারা, বাবু নগরী ও মামুনুল হক বাদ !


২০ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪৪

ফাইল ছবি

সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে দৌড়ের উপর আছেন হেফাজতের নেতারা। সম্প্রতি দেশব্যাপি তান্ডব আর হুঙ্কার ছাড়া হেফাজত নেতাদের এখন অস্তিত্ব সঙ্কট তৈরী হয়েছে। কখনও দৌড়াচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আবার কখনো ধর্না দিচ্ছেন মন্ত্রীর কাছে। আর হেফাজতের আমির বাবুনগরী কখনো দুঃখপ্রকাশ আবার কখনো ২৬ মার্চের কর্মসূচি ছিলনা বলে পিট বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে সর্বশেষ মামুনুল হক আটক ও রিমান্ডে আসলে হেফাজত নেতাদের দৌড়ঝাঁপ আরো তীব্র হয়।

সূত্র বলছে, উগ্রবাদি ও জামাত বিএনপি ঘেষা দুই শীর্ষ নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হকসহ অন্তত ১০জন হেফাজতের কমিটি থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। মহান স্বাধীনতার মাসে এমনকি স্বাধীনতা দিবসের দিনে দেশব্যাপি যে তান্ডব হেফাজত কি বার্তা দিতে চেয়েছিল তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে আটক হেফাজত নেতাদের রিমান্ডে। কারা মদদ দিয়েছে বা কার মদদে তারা এ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেটি বের করা চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করেছেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। রাত দশটার দিকে এ বৈঠক শুরু হয়। সম্প্রতি হেফাজতের তাণ্ডব এবং পরবর্তী সময়ে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে আলোচনা করেন হেফাজতের নেতারা।

বৈঠকে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবির) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, তার ভাতিজা মাওলানা হাবিবুল্লাহ নিয়াজীসহ অন্তত ১০ জন নেতা বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

বৈঠক চলাকালে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের গাড়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসার সামনে এসে থামে। প্রথমে হাজী সেলিম গাড়ি থেকে নেমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রবেশ করেন। তার পিছু পিছু একই গাড়ি থেকে আরও কয়েকজন ‘হেফাজত নেতা’ মন্ত্রীর বাসায় প্রবেশ করেন।

বৈঠক শেষে রাত ১১ টা ১৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হন হেফাজতের নেতারা।

কী নিয়ে বৈঠক হয়েছে জানতে চাইলে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক শুরুর পর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জীর কাছে জানতে চাওয়া হয় সংগঠনের মহাসচিব নূরুল ইসলাম জিহাদী কোথায়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, উনাকে তো এখন পাবেন না।

কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি ঢাকায় একটা মিটিংয়ে আছেন। কোথায় জানতে চাইলে অবশ্য বলেননি তিনি।

বৈঠক শেষে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নূরুল ইসলাম জিহাদীকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। কিছুক্ষণ পরে তার ফোন বন্ধ হাওয়া যায়।

বৈঠকে অংশ নেয়া হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি মোবাইল ফোন ধরেননি।

এর আগে দুপুরে মালিবাগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদীর নেতৃত্বে একটি দল সাক্ষাৎ করে।

এদিকে জানা গেছে যে, গত কয়েকদিনে আল্লামা শফীর পুত্র আনাস মাদানী নেতৃত্বে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের অনেকেই বৈঠক করেছেন, তারা আলাপ আলোচনা করছেন। ঈদের আগেই হেফাজতের একটি নতুন অংশ আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

তবে মজার ব্যাপার হল যে, জুনায়েদ বাবুনগরী যখনই হেফাজতের আমীর নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই সময়ে হেফাজতের প্রধান অংশ পুরোটাই ছিল জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী এবং জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষে।

সেই সময়ে আল্লামা শফীর পুত্র এত সংখ্যালঘু ছিলেন যে, তিনি আলাদা অবস্থান শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি যখন তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখনও তিনি তার প্রতিবাদ করতে পারেননি।

কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ করে হেফাজতের একটি বড় অংশ মনে করছেন যে, সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে কওমী মাদরাসা সহ যে অর্জনগুলো হেফাজত করেছিল সেই অর্জনগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আবাসিক কওমি মাদ্রাসাগুলো বন্ধের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা। আর এজন্য তারা দুষছেন জুনায়েদ বাবুনগরীকে।

তারা মনে করছেন যে, যদি ভাস্কর্য বিরোধী এবং নরেন্দ্র মোদি বিরোধী আন্দোলন না করা হতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। এখন হেফাজতের অনেক শিক্ষক এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মনে করছেন যে বর্তমান নেতৃত্ব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে হেফাজতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে এবং মাদ্রাসার যে সুযোগ-সুবিধা সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

আর এই প্রেক্ষাপটেই হেফাজতের নতুন নেতৃত্বের মেরুকরণ হচ্ছে। জানা গেছে যে, হেফাজতের জুনায়েদ বাবুনগরীর যে কমিটি আছে সেই কমিটির অন্তত ৬০ শতাংশ এখন আনাস মাদানীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং তার প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছেন।

একাধিক সূত্র বলছে, আনাস মাদানীর সঙ্গে সরকারের একটি অংশের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের অনেকেই আল্লামা শফীকে পছন্দ করতেন, তাকে একজন আলেম হিসেবে মানতেন।

কিন্তু জুনায়েদ বাবুনগরীকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেই মনে করছেন আওয়ামী লীগের ওই অংশ। যার ফলে জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে এখন কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতা করার পক্ষপাতী নয় সরকার।

সরকার বরং আনাস মাদানীর নেতৃত্বে যদি হেফাজত হায়, তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। আর এই প্রেক্ষাপটেই শক্ত একটা ভিত পেয়েছেন আনাস মাদানী। যারা আগে তাকে উপেক্ষা করেছিল, যারা তার নেতৃত্ব সেই সময় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল,

তারাই এখন আনাস মাদানীর সঙ্গে নিজেরাই যোগাযোগ করছেন। তাদের যোগাযোগের কারণেই এখন নতুন একটি হেফাজতের জন্মগ্রহণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একাধিক সূত্র বলছে যে, আনাস মাদানী খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করবেন যে কমিটিতে জুনায়েদ বাবুনগরী মামুনুল হকের মত বিতর্কিত ব্যক্তিরা থাকবেন না। আনাস মাদানী সকলকে বলছেন হেফাজতকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে রাখতে হবে এবং অরাজনৈতিক পরিচয়ে হেফাজত শক্তিশালী হবে।

যদি হেফাজতের কোন রাজনৈতিক আবরণ তৈরি হয়, তাহলে হেফাজতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই মতাদর্শ বিশ্বাস করছেন হেফাজতের অনেকেই। যার ফলে খুব শিগগিরই হয়তো হেফাজতের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং নতুন একটি হেফাজত দেখা যাবে।