নয়ন আমাদের নগ্ন দৃশ্য গোপনে ভিডিও করত
নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে চাঞ্চ্যলকর তথ্য। নিজেকে সত্যিকারের একজন প্রেমিকা দাবি করে মিন্নি জবানবন্দিতে বলেন, প্রেম আর ভালোবাসা দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন রিফাত শরীফের মন। আর সেই ভালোবাসার জোরেই রিফাত শরিফের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।
প্রেমের সম্পর্কের কারণে নয়ন বন্ডের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। নয়নের বাসায় দুজনের শারীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি ও ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি প্রথমে জানতাম না বলেও জানান মিন্নি।
কিন্তু পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে মিন্নি একজন প্রতারক ও ছলনাময়ী নারী। যে কিনা রিফাত শরীফের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও নয়ন বন্ডের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছেন। বিয়ে করেছেন। এমনকি বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরও নয়নের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আবার সেই মিন্নিই তার স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।
রিফাত হত্যার ২০ দিন পর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর মিন্নি প্রধান সাক্ষী থেকে হন আসামি। এরপর পাঁচ দিনের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় রিফাত হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা করা হয়।
জবানবন্দিতে মি ন্নি আরও বলেন, ‘আমি বরগুনা সরকারি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করি। ২০১৮ সালে বরগুনা আইডিয়াল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করি। আইডিয়াল কলেজে পড়াশোনা করার সময় ২০১৭ সালে রি ফাত শরীফের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ সময় রিফাত বামনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিল।
সম্পর্কের পর রিফাত আমাকে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার মধ্যে নয়ন ব ন্ড একজন। পরিচয়ের পর থেকেই ন য়ন ব ন্ড আমাকে কলেজে যাওয়ার পথে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে উত্ত্যক্ত করতো। আমি তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় সে আমার বাবা ও ভাইয়ের ক্ষতি করার ভয় দেখাতো। বিষয়টি আমি রিফাত শরীফকে জানাইনি।’
জবানবন্দিতে মিন্নি আরও বলেন, ‘আমি রিফাত শরীফকে ভালোবাসতাম। কিন্তু রিফাতের সঙ্গে অন্য মেয়েদের সম্পর্ক ছিল। এ কারণে রিফাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। এরপর আমি ধীরে ধীরে নয়ন ব ন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ি। একসময় আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরপর থেকে আমার নয়ন বন্ডের বাসায় যাতায়াত শুরু হয়। তার বাসায় আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক শুরু হয়। সে সময় শা রীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি ও ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি জানতাম না।
এভাবে প্রায়ই নয়নের বাসায় আমাদের শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। এরপর ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর বিকেলে রোজী আন্টির বাসায় যাওয়ার সময় নয়ন বন্ড আমাকে ব্যাংক কলোনি থেকে রিকশায় করে তার বাসায় নিয়ে যায়।
নয়নের বাসায় গিয়ে আমি শাওন, রাজু, রিফাত ফরাজী ও আরও সাত থেকে আটজনকে দেখতে পাই। এরমধ্যে শাওন বাইরে গিয়ে কাজী ডেকে আনে। পরে আমাদের মধ্যে বিয়ে হয়। এরপর আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে নয়নকে ফোন করে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলি। তখন নয়ন আমাকে বলে ওইটা বালামে উঠে নাই। বালামে না ওঠলে বিয়ে হয় না। এরপরও আমি নয়নের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখি। নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবারের কেউ জানে না।
২০১৯ সালের শুরুর দিকে কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস মিস করি। তখন নয়নের মোটরসাইকেলে আমি কুয়াকাটা যাই। সেখানে নয়নের সঙ্গে একটি হোটেলে রাত্রীযাপন করি।
এরপর আস্তে আস্তে আমি জানতে পারি নয়ন মাদকসেবী। ছিনতাই করে। তার নামে থানায় অনেক মামলা আছে। যে কারণে নয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়। এরপর আমি আবার রিফাত শরীফের সঙ্গে পূর্বের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি।
গেল ২৬ এপ্রিল পারিবারিকভাবে রি ফাত শ রীফের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত শা রীরিক সম্পর্ক সবই চলতো। বিয়ের পর জানতে পারি রিফাত শরীফও মাদকসেবী। সে মাদকসহ পুলিশের কাছে ধরা খায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।
আমি রি ফাতসহ আমার বাবার বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতাম। নয়ন বন্ডের বিষয় নিয়ে রিফাত শ রীফের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হতো। রিফাত শরীফ আমার গায়ে হাত তুলতো।
গেল ২৪ জুন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দিয়ে বলে- তোর স্বামী হেলালের ফোন ছিনাইয়া নিছে। পরে রি ফাত ফরাজীও আমাকে ফোন দিয়ে বলে হেলালের মোবাইলটি রিফাতের কাছ থেকে নিয়ে হেলালকে ফেরত দিতে। আমি রিফাত শরীফকে হেলালের ফোন ফেরত দিতে বললে রিফাত শরীফ আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে এবং তলপেটে লাথি মারে। বিষয়টি রাতে মোবাইল ফোনে নয়নকে জানাই এবং কান্না করি।
পরদিন ২৫ জুন আমি কলেজে গিয়ে নয়নের বাসায় যাই। রি ফাত শ রীফকে একটা শিক্ষা দিতে হবে একথা নয়নকে বললে নয়ন বলে, হেলালের ফোন নিয়ে যে ঘটনা তাতে রিফাত ফরাজী তাকে মারবে। তারপর আমি বাসায় চলে আসি এবং এ বিষয়ে কয়েকবার আমার নয়ন ব ন্ডের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। নয়ন ব ন্ডের সঙ্গে আমার স্বামী রিফাত শরীফকে মেরে শিক্ষা দিতে হবে এ পরিকল্পনা করি।
২৬ জুন আমি কলেজে যাই এবং সায়েন্স বিল্ডিং এর পাশের বেঞ্চের ওপর রিফাত ফরাজী ও রাব্বী আকনকে বসা পাই। রিফাত হাওলাদার পাশে দাঁড়ানো ছিল। তখন আমি রিফাত হাওলাদারকে বলি খালি হাতে আসছ কেন। একথার জবাবে রিফাত হাওলাদার বলে ওকে মারার জন্য খালি হাতেই যথেষ্ট।
এরপর রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসা করি নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ কলেজে এসেছে কিনা? তখন নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দেয়। রিফাত কোথায় জানতে চায় এবং আমাকে নতুন ভবনের দিকে যেতে বলে। ওই সময় নয়ন নতুন ভবনের পাশের দেয়াল টপকে ভেতরে আসে।
এ সময় রি ফাত শ রীফ কলেজের ভেতরে আসে এবং আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আসে। কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে না উঠে সময় ক্ষেপণ করার জন্য পুনরায় কলেজ গেটে ফিরে আসি। রি ফাত শ রীফ আমার পেছন পেছন ফিরে আসে। তখন রিশান ফরাজী কিছু পোলাপানসহ আসে। এ সময় রিশান ফরাজী রিফাতকে জিজ্ঞাসা করে- তুমি আমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছ কেন? রিফাত শরীফ বলে, আমি গালি দেই নাই।
ওই সময় রি ফাত ফ রাজী জামার কলার ধরে এবং রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে। রি ফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়, রিশান ফরাজী, রিফাত হাওলাদার এবং আরও অনেকে রিফাত শরীফকে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মারধর করতে করতে এবং টেনে হেঁচড়ে ক্যা লিক্সের দিকে নিয়ে যায়। ক্যালিক্সের সামনে তারা রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে।
আমি তখন সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় নয়ন ব ন্ড ক্যা লিক্সের সামনে এসে রিফাত শরীফকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। মারপিটের মধ্যেই রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে যায় এবং রিফাত ফরাজী দুটি দা এবং টিকটক হৃদয়, রিফাত হাওলাদার লাঠি নিয়ে আসে। একটি দা দিয়ে নয়ন বন্ড ও অন্য একটি দা দিয়ে রিফাত ফরাজী রি ফাত শ রীফকে কোপাচ্ছিল। রিশান ফরাজী এ সময় রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখে। বেসরকারি টেলিভিশন আর টিভির থেকে সংবাদটি নেয়া।
যেন রিফাত শ রীফ পালাতে না পারে। রিফাত শরীফকে কোপাতে দেখে আমি নয়ন ব ন্ডকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি। দায়ের কোপের আঘাতে রি ফাতের শরীফ রক্তাক্ত হয়। সে রক্তাক্ত অবস্থায় পূর্ব দিকে হেঁটে যায় এবং আমি রাস্তায় পড়ে থাকা জুতা পরি। এক পথচারী একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দিলে আমি রিকশা করে তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর আমার বাবাকে ফোন করি। আমার বাবা ও চাচা হাসপাতালে আসে। এরপর রি ফাত শ রীফকে বরিশাল পাঠানো হয়। আমার কাপড়ে রক্ত লেগে থাকায় আমি বাসায় চলে যাই। পরে আমি জানতে পারি রিফাতের অবস্থা খারাপ। এরপর নয়নকে ফোনে বলি তোমরা ওকে যেভাবে কোপাইছো তাতে তো ও মারা যাবে এবং তুমি আসামি হবা। তারপর ওর অবস্থান জানতে চাই এবং পালাতে বলি। দুপুরের পর খবর পাই রি ফাত শ রীফ মারা গেছে।
তবে এই জবানবন্দিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন নাটকের পাণ্ডুলিপি দাবি করে বলেছেন, আমার মেয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে অনেক সত্য গোপন করা হয়েছে। আবার অতিরঞ্জিত অনেক কিছু যোগ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রিফাত শরীফ হত্যার ভিডিও ভাইরাল না হলে বলা হতো আমার মেয়ে মিন্নিই তার স্বামীকে কুপিয়ে হ ত্যা করেছে।