ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৩রা অক্টোবর ২০২৪, ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১


রপ্তানি বন্ধেও চড়া ইলিশের দাম


৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩১

ফাইল ফটো

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। এই মাছের নাম এলেই অতুলনীয় স্বাদ আর গন্ধের অদ্ভুত অনুভূতি জাগে রসনাবিলাসী প্রতিটি বাঙালির মনে। অথচ জাতীয় এই মাছের অভয়ারণ্য যে দেশে, সেই দেশের মানুষের কাছে সুস্বাদু সেই ইলিশ এখন অনেকটাই দুর্লভ। সমুদ্রে বেড়ে ওঠা এই মাছটির দাম বেড়ে এমন স্তরে পৌঁছে যে তা রীতিমতো এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

 

গত সরকারের সময় পাশের দেশ ভারতে রপ্তানি হতো বলে অজুহাত দেখাতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন রপ্তানি বন্ধ। তার পরও কেন কমছে না ইলিশের দাম? সবার মনে এই প্রশ্ন। 

ব্যবসায়ীদের দাবি, সাগরে এখন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে।

 

মৌসুম শেষের দিকে, একই সঙ্গে উজান থেকে বন্যার পানি আসায় ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী যখন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে, তখন দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেই ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন।

ইলিশ ধরা ও ধাপে ধাপে বিক্রি

 

মাছ ধরার জন্য ভোলা, চাঁদপুরসহ উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রায় ২২-২৪ ঘণ্টা বোট চালাতে হয়।

 

এরপর পাওয়া যায় মাছ ধরার বিশাল এলাকা। সেখানে জেলেরা জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে সমুদ্রে জাল ফেলেন। এভাবে পাঁচ-ছয় দিন সমুদ্রে মাছ ধরে আবার এলাকায় ফেরেন। ফেরার পর বোট বা ট্রলারের মালিকের কাছ থেকে ডাক ধরে আড়তদার মাছ কিনে নেন। সেই আড়তদার মাছ কিনে ঢাকায় পাঠান।

ওই মাছ ঢাকার আড়তদার একটি নির্ধারিত কমিশন নিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। এরপর তাদের কাছ থেকে কিনে নেন ভোক্তা। অর্থাৎ একটি মাছ ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে দুইবার বিক্রি হয়। তৃতীয় পর্যায়ে এসে মাছ কিনতে পারেন সাধারণ ক্রেতারা।

একটি ট্রলারে সর্বোচ্চ ৬০ মণ মাছ পাওয়া যায়। যা ১৫-২০ লাখ টাকায় বিক্রি করেন জেলেরা বা ট্রলার মালিকরা, যা গড়ে প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ে ৮৩৩ টাকা। এই দাম ছোট-বড় সব আকারের মাছের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্থানীয় আড়তদার মাছগুলো নিয়ে চারটি ভাগে আলাদা করেন। প্রথম ধাপ সরাসরি জাটকা। দ্বিতীয় ধাপ ১০ ইঞ্চির ওপরের (স্থানীয় নাম ব্যালকা), তৃতীয় ধাপ ৭০০-৯০০ গ্রাম (মাজলা)। চতুর্থ ধাপ এক কেজির ওপর ওজন (গ্রেড)। ছোট থেকে আকারে বড় মাছের ক্ষেত্রে দামে কম বেশি হয়। তবে বড় আকারের মাছগুলোর কোনোটিই ৯০০ টাকা কেজির নিচে কিনতে পারেন না ভোক্তারা। এতে কোনো উত্পাদন খরচ ছাড়া পাওয়া ইলিশ এখন দেশের মানুষের বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে।

 

আকার ভেদে দাম

 

সমুদ্র থেকে মাছ ধরার পর তা সারা দেশে পাঠানো হয়। বড় একটি অংশ যায় রাজধানীতে। ঢাকা শহরের অন্যতম পাইকারি ও খুচরা মাছ বিক্রি হয় কারওয়ান বাজারে। এই বাজারে ১২০০-১৩০০ গ্রাম ওজনের মাছ খুচরায় সাধারণত ১৭০০-১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের মাছের বিক্রি হয় ১৪৫০-১৫০০ টাকা কেজি। আর যেসব মাছের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম সেগুলো বিক্রি হয় ৯০০-১০০০ টাকা কেজিতে। তবে মাছের সরবরাহ ও শহরের বিভিন্ন স্থানে মাছের দাম ১০০-১৫০ টাকার কম-বেশি হয়। তবে সুপারশপগুলোতে এর চেয়ে আরো বেশি দামে বিক্রি হয় ইলিশ। 

 

সুপারশপ মিনাবাজারের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, প্রতিটি ১২০০-১৪৯৯ গ্রামের ইলিশের দাম দুই হাজার ৩৮৮ টাকা, এক কেজি থেকে ১১৯৯ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার ৮২৪ টাকা, ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম প্রতি কেজি এক হাজার ১৪৬ টাকা। 

 

অন্যদিকে সুপারশপ স্বপ্ন বিক্রি করছে এক কেজি থেকে ১১৯৯ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ৮৫০ টাকা কেজি, একইভাবে ৫০০-৫৯৯ গ্রামের ওজনের ইলিশের দাম ১৩০০ টাকা কেজি।

 

ইলিশ ধরেন মূলত উপকূলীয় এলাকার জেলে ও মাঝিরা। বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, পিরোজপুরসহ উপকূল জেলার জেলেরা গভীর সমুদ্র থেকে ইলিশ মাছ ধরে নিয়ে আসেন। দেশের প্রায় ৩২ শতাংশ ইলিশ এই জেলার জেলে-মাঝিরা সংগ্রহ করেন। তবুও মাছ ঘাটগুলোতে ইলিশের দাম আকাশ ছোঁয়া। সবচেয়ে বড় আকারের প্রতি কেজি ইলিশ ভোলায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৫০০-১৭০০ টাকায়। মত্স্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা বলছেন, মাছ শিকারে খরচ বেশি এবং জালে মাছ কম ধরা পড়ায় দাম কমছে না। জেলেরা আরো জানান, একেকটি নৌকায় ছোট-বড় মিলিয়ে সর্বোচ্চ চার-পাঁচ হালি ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

 

চরফ্যাশনের সামরাজ মাছঘাটের চান শরীফ মাঝি জানান, তিনি ২২ জন মাঝিমাল্লা নিয়ে সাত দিন আগে সাগরে মাছ শিকারে যান। ফিরে আসেন ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৭৫ হালি ইলিশ নিয়ে। এগুলো ঘাটে এনে সাড়ে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেন। 

 

একই ঘাটের আড়ৎদার মো. আলাউদ্দিন জানান, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চললেও উল্লেখযোগ্য হারে ইলিশ মিলছে না। সাগরে ১০০ বোট মাছ শিকারে গেলেও পাঁচ-সাতটি বোট মোটামুটি মাছ পায়। বেশির ভাগ বোটই কম ইলিশ পাচ্ছে। তাই মাছের দাম কমছে না। এ ছাড়া একেকটি বোট সাগরে গেলে ২২ জনের মাঝিমাল্লা, জ্বালানি তেল, সাত-আট দিনের বাজারসহ তিন-চার লাখ টাকা খরচ হয়। আর মাছ পাওয়া গেলে ৫০-৬০ মণ হয়, যা বিক্রি করা যায় ১৫-২০ লাখ টাকায়। তবে এখন এত বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বোটকেই লোকসান দিতে হচ্ছে।

 

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, জেলায় সারা বছরই কম-বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। তবে জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। প্রায় ১৫ দিন ধরে নদীতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। তবে কিছুদিন আগে টানা বৃষ্টিতে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলেদের জালে ইলিশ কম ধরা পড়ছে। সামনের দিকে মাছ ধরার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তখন দাম কমে আসবে। এ বছর ইলিশের সাইজ বেশ বড়। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন ঘাটে দৈনিক ৪০০-৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে জেলায় এক লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।