কড়াইল বস্তিতে চাঁদাবাজির ভযঙ্কর গ্যাং

রাজধানীর অপরাধের আখড়া হিসেবে পরিচিত বস্তি। আর বস্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত বনানীর কড়াইল বস্তি। অভিযাত এলাকার মধ্যে অবস্থিত এ বস্তিকে ঘিরে এমন কোন অপরাধ নাই যা হয় না। খুন, ধর্ষণ, মাদক থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধের আখড়া হিসেবে পরিচিত। গত বুধবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষে খুন হয় আলামিন নামের এক মুদি দোকানী। প্রকৃতপক্ষে সে মুদি দোকানী হলেও একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রন করতো। আধিপত্যের জেরে তাকে এলোপাথাড়ি ছুরিকাহতে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় আরো কয়েকজন আহত হয়। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বস্তিকে ঘিরে এখানে একটি ভয়ংকর গ্যাং রয়েছে। আর এই গ্যাংয়ের প্রায় দুই শতাধিক ক্যাডার রয়েছে। এই ক্যাডাররাই সব নিয়ন্ত্রন করে। প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। যখনই কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করেছে তাকেই হয় খুন হতে হয়েছে নইতো মারধরের শিকার হতে হয়েছে।
তারা বলছেন, মাদক বাদ দিয়েই বস্তি থেকে বাড়ি ভাড়া, বাড়ি তৈরী, অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগের বিল বাবদ পুরো বস্তি অর্থাৎ প্রায় ৮০ হাজার পরিবার থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা টাকা উঠে। আর এ কারণে এখানে তৈরী হয়েছে নানা গ্রুপ উপগ্রুপ। এমনকি এখানে আধিপত্য ধরে রাখতে দেশের বাইরে থেকেও সন্ত্রাসীরা নেতৃত্ব দেয়।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ উদ্দিনের একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল নিয়ন্ত্রন করছে সব। চাঁদাবাজিতে তার ক্যাডাররাই বেশি সক্রিয়। এ টাকার একটি অংশ কাউন্সিলর মফিজও পায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই সন্ত্রাসীদের আস্তানা এবং রাজধানীর অন্যতম মাদক স্পট হিসেবে পরিচিত কড়াইল বস্তি উচ্ছেদে সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত বস্তিটি বহাল তবিয়তে আছে। এর দখল নিয়েও বহুবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এখন আর আগের মতো সংঘাত-সংঘর্ষ না হলেও অপরাধ থেমে নেই। অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর গা-ঘেঁষে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠা এই কড়াইল বস্তিতে কেউ জমির মালিক, কেউ বাড়ির মালিক কেউবা ভাড়াটিয়া, কেউ আবার হাওয়ার উপরেই বসবাস করছেন। কিন্তু কেউই প্রকৃত মালিক নন। আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, গণপূর্ত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরও এখানকার জমির মালিকের অভাব নেই, সেই জমি আবার কেনাবেচাও চলে। কখনো জমি, কখনো রেডিমেট বাড়ি কখনো জমি বাড়ি এক সঙ্গে বিক্রি হয়। একই জমির বারবার মালিকানা বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম। অনেকে আবার আবাসন ব্যবসাও শুরু করেছেন সরকারি জমির ওপর। গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিতে হয় এককালীন টাকা। এভাবেই টিকে আছে কড়াইল বস্তি।
অভিযোগ রয়েছে, ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ২০টি গ্রুপের সদস্যরা কড়াইল বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেক এলাকায় অবস্থান করে। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈঠক। এসব বৈঠকেই ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি এবং বাসাবাড়িতে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়। বেশিরভাগই কড়াইল বস্তিতে আস্তানা গেড়েছে। বস্তিতে কিশোর সন্ত্রাসী বা বস্তির খুদে রাজা হিসেবে পরিচিত। অনেকের নামে হত্যা থেকে শুরু করে মাদক-ছিনতাই, চুরি, গাড়ি ভাঙচুর ও ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, দিনের বেলায় কড়াইল বস্তির অবস্থা স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু রাতের বেলায় এই চিত্র বদলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই বস্তিতে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বাড়ে। বাড্ডা, কচুক্ষেত, খিলক্ষেত, ভাটারা, বেরাইদ, মহাখালী এবং তেজগাঁও এলাকার সন্ত্রাসীরা এই বস্তিতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি ঘরে এক মাসে প্রতিটি লাইটের জন্য ১০০ টাকা, ফ্যানের জন্য ১০০ টাকা, টেলিভিশনের জন্য ২০০ টাকা, ফ্রিজের জন্য ৩০০ টাকা দিতে হয়। গ্যাসের প্রতিটি চুলার জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর পানির লাইন ব্যবহার করতে প্রতিটি পরিবারকে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। পানির জন্য একটি পরিবারকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। এ হিসাবে ৮০ হাজার পরিবারের কাছ থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা আদায় করে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
একটি গ্যাসের চুলার জন্য বস্তিবাসীকে গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সাধারণত একটি চুলা তিনটি পরিবার ব্যবহার করে থাকে। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেয় প্রায় কয়েক কোটি টাকা।
আর বিদ্যুতের পেছনে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৪০০ টাকা করে গুনতে হয়। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট আদায় করে প্রায় ৩ কোটি টাকা। আর ঘরভাড়া বাবদ প্রতিটি ঘর থেকে দেড় হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। এ খাত থেকে ঘরের মালিক এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আয় প্রায় ১১ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার কারবার।
খোলামেলা মাদক বাণিজ্য: এক সময়ের বস্তি মসজিদের এক মুয়াজ্জিন এখন কড়াইল সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি ডাকসাইটে মাস্তান বনেছেন, জড়িয়ে পড়েছেন হেরোইন ফেনসিডিলসহ নানারকম মাদক ব্যবসায়। গোটা কড়াইল বস্তিজুড়েই তার একচ্ছত্র দাপট। তারই ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা হলেন ইয়াবা ডিলার। তাদের নেতৃত্বে কড়াইল বস্তি থেকেই গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারাসহ আশপাশের বিভিন্ন থানা এলাকায় ইয়াবার সরবরাহ যায়। এদের আরেক সহযোগী নূরুল ইসলাম বস্তির ঝিলপাড়ে বসিয়েছে রমরমা জুয়ার আসর। রাত-দিন সেখানে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলে।
বনানীর কড়াইলের বটতলার জলিলের মাদক স্পট, শাহ আলমের মাদক স্পট, টিঅ্যান্ডটি বাজারে পাগলির মাদক স্পট, আরশাদ নগর বস্তির জরিনার মাদক স্পট, এক নম্বর গোডাউন বস্তির ময়নার মার মাদক স্পট, আমতলীর জামাই মালেকের মাদক স্পট, ওয়্যারলেস গেটের ড্রাইভার কাশেমের মাদক স্পট, মহাখালী পশু হাসপাতাল সংলগ্ন নাটা ইউসুফের মাদক স্পট, সাততলা পুকুরপাড় মানিকের মাদক স্পট।
নিয়ন্ত্রন করেন যারা : অভিযোগ রয়েছে এক সমেয়র যুবলীগ উত্তরের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের ক্যাডাররাই এসব নিয়ন্ত্রন করে। চঞ্চল বর্তমানে আমেরিকায় থাকে। যুবলীগ নেতা জাহিদ হাসান মিল্কি হত্যাকান্ডের ঘটনায় সে চার্জশিটভুক্ত আসামি। ঘটনার পরপরই সে পালিয়ে যায়। চঞ্চল আমেরিকা থাকলেও এ এলাকায় তার হয়ে কাজ করে শুটার সোহেল, শহিদুল, জিল্লুর, ডানো বাবু এবং খলিল ওরফে বাড্ডার খলিল। এরাই পুরো বস্তিতে গ্রুপ করে দিয়ে নিয়ন্ত্রন করে। প্রতিমাসে যে পরিমান চাঁদা ওঠে এর একটি অংশ পেয়ে যায় কাউন্সিলর মফিজের নিকট। এ কারণে তিনি জনপ্রতিনিধি হয়েও বস্তির সকল অপকর্মে নিশ্চুপ থাকে।
তবে কাউন্সিলর মফিজ উদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বস্তির নিয়ন্ত্রন তিনি করেন না।
এদিকে আলামিন খুনের ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে বলে জানান বনানী থানার ওসি নূরে আজম মিয়া।