ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ভয়াল ১২ই নভেম্বর ৫ কোটি মানুষ উপকূলবাসী আজও কাঁদে


১২ নভেম্বর ২০২০ ০৬:৫০

ফাইল ছবি

আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর ৫ কোটি মানুষ উপকূলবাসী আজও কাঁদে ।এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা। করেবাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে।

বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বহু পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল।আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর ১৯৭০ সালের এই দিনে প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশের উপকূলীয় আঞ্চল। ভয়াবহ সেদিনের ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও আজো সে দুর্বিসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় উপকূলের বাসিন্দাদের। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। এই ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

উইকিপিডিয়ার সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবেও এটিকে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটির নাম ছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে।

জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্তহৃদয়বিদারক।

’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে মনপুরা উপকূলে প্রায় ৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে হাজিরহাট ইউনিয়নের পাটোয়ারী পরিবারে ৫৫ জন স্বজন প্রাণ হারায়। এছাড়াও অধিকাংশ পরিবারে ৭-১০ জন স্বজনের প্রাণ যায়। তখন বেতার ও টেলিভিশনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার আজকের মতো জোরদার ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ছিল না কোন আশ্রয়কেন্দ্র।

নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও এত মানুষের প্রাণহানি হত না বলে মন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মনপুরাবাসীকে সমবেদনা জানাতে হেলিকাপ্টারে ছুটে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রত্যেকটি পরিবারের স্বজন হারানো মানুষের সাথে দেখা করে সমবেদনা জানান। পরে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেন।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।

তোফায়েল আহমেদ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন, মা-বাবা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। প্রতি বছর আমাদের জাতীয় জীবনে যখন ১২ নভেম্বর ফিরে আসে, তখন বেদনাবিদুর সেই দিনটির কথা স্মৃতির পাতায় গভীরভাবে ভেসে ওঠে।’৭০-এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি।১ জানুয়ারি ’৭০-এ রাজনৈতিক তত্পরতার ওপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহূত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমার নেতৃত্বে সে দিন প্রথম জনসভা করি পল্টনে। তখনই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিবো।’ এই কথাটি ভীষণভাবে আমার হূদয়কে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না,—ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক তত্পরতা চালাই। বঙ্গবন্ধু ১৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এই মোটরবাইক ছিল আমার যানবাহন।

সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত ছিলাম আমার নির্বাচনী এলাকায়। কয়েকদিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি আর সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়া এবং অন্য নেতাদের নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলত খাঁ থানা, তজমুদ্দি থানা। তখন মনপুরা থানা হয়নি। কিন্তু মনপুরার তিনটি ইউনিয়নও আমার নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর একটি এলাকা ছিল বোরাহানউদ্দিন, লালমোহন এবং চরফ্যাশন। আমার নির্বাচনী এলাকাটি বড় ছিল। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন তখন আমার বয়স মাত্র ২৬।বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত-অসহায় মানুষের জন্য এলাকায় এলাকায় ক্যাম্প করে যে ব্যাপক ত্রাণকার্য সেদিন আমি পরিচালনা করেছি তা আমার বাকি জীবনে চলার পথের পাথেয় হয়ে আছে। জাতীয় চার নেতার অন্যতম শ্রদ্ধেয় নেতা তাজউদ্দীন ভাই এক বিরাট লঞ্চভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ভোলা এসেছিলেন ত্রাণকার্যে। তার থেকে কিছু তিনি বিলি করতে পেরেছেন বাকিগুলো রেখে এসেছিলেন আমার কাছে। সেগুলো আমি বিলি-বণ্টন করেছি। খাবার পানি, মুড়ি, চিঁড়া, ওষুধ-পথ্য বিলি করেছি দুর্গত এলাকায়।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান।

১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।