ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


দোয়া করার সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরী


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:২২

প্রতিকি

মুসলমান হিসেবে আমরা সবাই কম-বেশি দোয়া করে থাকি। এটা অনেকটা স্বভাবজাত বিষয়। তবে দোয়া করার সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে খেয়াল রাখা দরকার। এগুলোকে আলেমরা দোয়া কবুলের শর্ত ও আদব বলে অভিহিত করেছেন। তা হলো- ১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে না ডাকা ২. শরিয়ত অনুমোদিত কোনো একটি মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে ওসিলা চাওয়া ৩. দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা ৪. দোয়ার মধ্যে পাপের কিছু না থাকা ৫. আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা নিয়ে দোয়া করা ৬. দোয়ায় মনোযোগ থাকা ৭. খাদ্য পবিত্র [হালাল] হওয়া ৮. দোয়ার ক্ষেত্রে কোনো সীমা লঙ্ঘন না করা ৯. ফরজ আমল বাদ দিয়ে দোয়ায় মশগুল না হওয়া ১০. পবিত্রতার সাথে দোয়া করা ১১. বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা ১২. মিনতিভরা কণ্ঠে দোয়া করা ১৩. দু’হাত তুলে দোয়া করা ১৪. আল্লাহর প্রশংসা ও দরূদ শরিফসহ দোয়া করা।

দোয়া বা প্রার্থনা দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্যা সমাধানের অন্যতম মাধ্যম। তবে দোয়া হতে হবে সঠিক পন্থায়। চাইতে হবে শুধু আল্লাহ তাআলার কাছে। তাই মানুষের সমস্যা সমাধানে বেশি বেশি দোয়া করলে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমাকে ডাকো; আমি তোমাদের উত্তর দেব (তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব)।’ দোয়া স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। আল্লাহর কাছে মানুষ যত চাইবে আল্লাহ তত দেবেন। আল্লাহ চান বান্দা প্রতিটি বিষয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করুক। বান্দা যত চায় আল্লাহ তাতে তত খুশি হন। তবে দোয়া কবুলের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও আদব আছে। নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে দোয়া করলে আশা করা যায় আল্লাহ তা কবুল করবেন। দোয়া কবুলের জন্য দিন-রাতের মাঝে এমন অনেক সময় ও মুহূর্ত রেখেছেন, যে সময় দোয়া করলে তা কবুল হয় বলে হাদিসে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। দোয়া কবুলের বিশেষ কিছু মুহূর্ত ও অবস্থা এখানে আলোচনা করা হলো।

রাতের শেষ তৃতীয়াংশ : এই সময় দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে সহিহ হাদিসে অত্যন্ত জোরালোভাবে বলা হয়েছে। এটা প্রতিটি রাতের জন্যই প্রযোজ্য, শুধু শবেবরাত, শবেমিরাজ বা কদরের রাতে নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেকদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের রব [আল্লাহ] সবচেয়ে নিচের আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আমাকে ডাকছো, আমি তোমার ডাকে সাড়া দেবো। কে আমার কাছে চাইছো, আমি তাকে তা দেবো। কে আছো আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। [সহিহ বুখারি শরিফ]আজান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময় : মক্কা কিংবা মদিনার নামাজের জামায়াত শুরু হওয়ার মাঝখানে অনেক মুসলিমকে দেখা যায় নামাজ শুরুর আগে হাত তুলে দোয়া করতে। এ সময়টা দোয়া কবুল হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আজান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। [আবু দাউদ শরিফ : ৫২১, তিরমিজি শরিফ : ২১২]

জুমার দিন : জুমার দিনে এমন অসাধারণ একটি নিয়ামতের সময় আছে যে সময়টায় দোয়া কবুল হওয়ার বিশুদ্ধ বর্ণনা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের একদিন শুক্রবার নিয়ে আলোচনা করলেন এবং বললেন, ‘জুমার দিনে একটি সময় আছে যে সময়টা কোনো মুসলিম সালাত আদায়রত অবস্থায় পায় এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা মেটাবেন’ এবং তিনি [রাসুল সা.] তাঁর হাত দিয়ে ইশারা করে সে সময়টা সংক্ষিপ্ততার ইঙ্গিত দেন। [সহিহ বুখারি শরিফ]। কোনো কোনো স্কলার সে সময়টার ব্যাপারে বলেছেন, তা হলো- ইমাম যখন মসজিদে প্রবেশ করেন সে সময় থেকে সালাত শেষ হওয়ার সময় পর্যন্ত। কেউ বলেছেন, দুই খুতবার মাঝখানে, কেউ আবার জোর দিয়ে বলেছেন তা হলো আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়টা।

জমজমের পানি পান করার সময় : হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জমজম পানি হলো তার জন্য, যার জন্য এটি পান করা হয়। [ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৩০৬২, আহমাদ ৩/৩৫৭] অর্থাৎ, জমজমের পানি পান করার সময় আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয়, তা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সিজদার সময় : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে সময়টায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটতম অবস্থায় থাকে তা হলো সিজদাহর সময়। সুতরাং তোমরা সে সময় আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাও। [সহিহ মুসলিম শরিফ, আবু দাউদ, নাসায়ি]

রাতের বেলা ঘুম থেকে জাগ্রত হলে : হজরত উবাদা ইবনুস সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউ রাতের বেলা ঘুম থেকে জাগে আর বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির, আলহামদুলিল্লাহি ওয়া সুবহানাল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ এবং এরপর বলে ‘আল্লাহুম মাগফিরলি [আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন] এবং আল্লাহর কাছে চায়, তাহলে তার ডাকে সাড়া দেওয়া হবে এবং সে যদি অজু করে সালাত আদায় করে, তাহলে তার সালাত কবুল করা হবে। [সহিহ বুখারি শরিফ]

ফরজ সালাতের পর : হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কোন সময়ের ডাক শোনা হয়? তিনি বললেন, রাতের শেষ সময়ে এবং ফরজ সালাতের পরে। [তিরমিজি শরিফ] অনেক স্কলার বলেছেন, এ সময়টা হলো, সালাম ফেরানোর আগের সময় [আত্তাহিয়াতুর পর]।

কদরের রাতে : নিঃসন্দেহে লাইলাতুল কদর হলো একটি বছরে কোনো মানব সন্তানের পাওয়া শ্রেষ্ঠ রাত। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমরা এটি [আল-কোরআন] কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জানো কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও অধিক উত্তম। [সুরা কদর : ১-৩] সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত একাধিক বিশুদ্ধ হাদিসে এ রাতের সকল ইবাদত ও আল্লাহর কাছে চাহিদা পূরণের কথা বলা হয়েছে।

বৃষ্টি ও আজানের সময় : হজরত সাহল ইবন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুই সময়ের দোয়া ফেরানো হয় না। আজানের সময়ের দোয়া আর বৃষ্টি পড়ার সময়কার দোয়া। [আবু দাউদ শরিফ , হাদিস নং : ২৫৪০]

নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া : মজলুমের দোয়া এবং বদদোয়া দুটোই আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত মুয়াজকে বলেছেন, মজলুমের দোয়া থেকে সবসময় সতর্ক থেকো, কেননা মজলুমের দোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা বা আশ্রয় থাকে না। [সহিহ বুখারি শরিফ]

মা, বাবা, রোজাদার ও মুসাফিরের দোয়া : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনটি দোয়া [আল্লাহর দ্বারা] ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া, রোজাদার ব্যক্তির দোয়া, মুসাফিরের দোয়া। [বায়হাকি, তিরমিজি] এছাড়াও পুরো রমজান মাসই হলো আল্লাহর কাছে চাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমজান মাসে করুণার দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। [সহিহ বুখারি শরিফ, হাদিস নং : ১৮৯৯]

অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার পর : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমরা কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাও, তখন ভালো কথা বলো [ভালো কিছু চাও], কেননা তোমরা তখন যা-ই বলো, তার সাথে সাথে ফেরেশতারা ‘আমিন’ বলেন। [সহিহ মুসলিম শরিফ]। এছাড়াও জামাতের সুরা ফাতিহা পড়ার পর আমিন বলার সময়, মসজিদুল হারামের ভেতর, কাবার সামনে, পিতা-মাতার জন্য সন্তানের দোয়া, হজের সময় কংকর নিক্ষেপের সময়সহ এমন আরো অনেক সময়ই দোয়া কবুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে সহিহ হাদিসে এসেছে।

শ্রেষ্ঠ দোয়া : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ অসংখ্য দোয়া উল্লেখ করেছেন এবং এগুলোই দোয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এর মধ্যে একটি দোয়ার কথা সহিহ হাদিসে এসেছে যেটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি পড়তেন। তা হলো, রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান নার। অর্থ : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দুনিয়ায় কল্যাণ দিন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দিন আর আমাকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’ তবে উল্লিখিত সময়সহ সকল সময়েই আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করার জন্য সর্বদা জাগ্রত আছেন। আমরা যদি এরপরও তার কাছে ক্ষমা না নিয়ে পৌঁছাতে না পারি তাহলে তা হবে আমাদের জন্য পরম দুর্ভাগ্য। আল্লাহ আমাদের পৃথিবীর জীবন ও পরবর্তী জীবনের দোয়াগুলো কবুল করুন, আমাদের চাহিদাগুলো মিটিয়ে দিন এবং যাদের নাম আল্লাহ নাজাতপ্রাপ্তদের খাতায় লিখে রেখেছেন, তাদের ভেতর আমাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।