ঢাকা রবিবার, ১২ই মে ২০২৪, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩১


অস্তিত্ব সংকটে, টিকে থাকার লড়াই ছোট দলগুলোর


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:৪১

প্রতিকি

রাজনীতির মাঠে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ছোট দলগুলো। ডান, বাম বা ইসলামি দল-সবার প্রায় একই অবস্থা। গত এক বছরে করোনা মহামারির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে তাদের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা। এ সময়ে দলীয় বা জোটগতভাবেও তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। তীব্র শীতেও এদের প্রায় কাউকেই দুস্থ মানুষের পাশে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বাইরে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৭টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আছে নিবন্ধিত আটটি রাজনৈতিক দল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যাও ৭টি। দুই জোটের বাইরে আরও আছে ২২টি নিবন্ধিত দল। নিবন্ধন নেই ডান, বাম, ইসলামি মিলিয়ে আরও প্রায় ৭০টি রাজনৈতিক দল আছে কাগজে-কলমে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের দলগুলো নানাভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ভোটের পর থেকে তাদের তৎপরতা হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমান সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনার আঘাত। বৈশ্বিক এই মহামারির প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সময় গড়াতেই মুখ থুবড়ে পড়ে অধিকাংশেরই কর্মকাণ্ড।

করোনার দীর্ঘ এক বছরে বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই সারা দেশে পর্যায়ক্রমে পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে। এখন চলছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি। স্থানীয় সরকার পরিষদের এসব নির্বাচনে তিন বড় দলের বাইরে ছোট ছোট দলের কারও কোনো অংশগ্রহণ খুব একটা চোখে পড়েনি। তাদের দাবি, সর্বগ্রাসী করোনার কারণে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড থমকে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আবার সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকবে।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম বলেছেন অন্য কথা। তিনি বলেন, ছোট ছোট দলের শক্তি, সামর্থ্য, জনপ্রিয়তা এবং গণভিত্তি একেবারে নেই বললেই চলে। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। দুই বড় দলের সঙ্গে একটি বা দুটি আসন পাওয়ার আশায় জোট বাঁধে। অনেক রাজনৈতিক দল আছে শুধু এক নেতার নেতৃত্বে চলে। এখানে দলীয় নীতি বা আদর্শের চেয়ে শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত আদর্শ, নীতি এবং স্বার্থরক্ষার বিষয়টিই প্রাধান্য পায় বেশি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কালেভদ্রে কিছু কর্মসূচির আয়োজন ছাড়া আর ছোট ছোট দলের কোনো কার্যক্রম, এমনকি সাংগঠনিক তৎপরতাও নেই। কেউ কেউ তো প্যাডসর্বস্ব, গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। করোনার সময় এসব দলের কারও কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। করোনার পাশাপাশি শীত গেল। এই শীতেও গরিব মানুষের পাশে কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অনেক দলের শীর্ষ নেতারা তো এই সময়ে ঘর থেকেই বের হননি। আসলে করোনা শুধু একটি অজুহাত মাত্র তাদের কাছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি-জেপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ জাসদ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকরা হচ্ছে : বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক দল-জাগপা, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।

করোনার পুরো সময় দুই বড় দলের বাইরে জোট বেঁধে চলা ছোট ছোট দলের কাউকে দেখা যায়নি মাঠে। জোটের বাইরে সিপিবি, গণফোরাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, ইসলামি ঐক্য জোট, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, লেবার পার্টি, ফরোয়ার্ড পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, পিপলস পার্টি, পিডিপি, বাসদ (মার্কসবাদী), ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল, বাসদ (মাহাবুব), সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলনসহ বাম, ডান এবং ইসলামি ভাবধারায় বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক দলকেই মাঠে দেখা যায়নি। তবে এই সময়ে বহিষ্কার পালটা বহিষ্কারসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় ছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল গণফোরাম। যদিও করোনার সময় গণমানুষের পাশে কোনো ভূমিকা পালন করতে দলটির কাউকে পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ছোট ছোট দল এমনিতেই বহুধাবিভক্ত। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক, আদর্শিক মতানৈক্য এবং নেতৃত্বের কোন্দল। বিভিন্ন ইস্যুতে নানা সময় ঐক্যবদ্ধ হলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূলত হাঁকডাক, কথার প্যাঁচালিতেই সীমাবদ্ধ তারা। হাতে গোনা কয়েকটি দলের মানববন্ধন ও মিছিলভিত্তিক কর্মকাণ্ড থাকলেও রাজনীতির মূল স্রোত হয়ে মানুষের মাঝে আশা জাগাতে পারছে না তারা। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বলা চলে একরকম অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে তারা। পাশাপাশি যেন টিকে থাকার লড়াই করছে দলগুলো।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, রাজনীতি যখন কালোটাকা আর পেশিশক্তির আবর্তে ঘুরপাক খায়, তখন এর বাইরে গিয়ে আদর্শিক ধারার রাজনীতি টিকিয়ে রাখা সত্যিই কষ্টের। তবুও আমরা সেই লড়াইটা করে যাচ্ছি। আমরা আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে আছি, থাকার চেষ্টাও করি। তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে আমার শক্তি এবং সামর্থ্যও কম। এই বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করছি না, অস্বীকার করার উপায়ও নেই। আবার এটাও সত্যি যে, আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সেভাবে গণমাধ্যম প্রচার-প্রকাশও করে না, যতটা তারা দুই বড় দলের বেলায় করে। ফলে মানুষ আমাদের তৎপরতার কথা জানতে পারে না।