জটিল সমিকরণে এরশাদের জাপা

জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) নবম জাতীয় কাউন্সিল ২৮ ডিসেম্বর। কাউন্সিল যতই ঘনিয়ে আসছে পদ-পদবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন সব সমীকরণ। দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের অবর্তমানে প্রথম নতুন পরিবেশে কাউন্সিল হওয়ায় শীর্ষ পদ নিয়ে আবারও সংকটে পড়তে পারে দলটি।
যদিও চেয়ারম্যান পদটিতে এখন পর্যন্ত জিএম কাদের একক প্রার্থী। তারপরও শীর্ষ নেতারা চান দলটির অন্যতম সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশনের হাতে থাকুক দল। এরশাদ জীবিতকালে চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়তি কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু এরশাদের অনুপস্থিতিতে এবারের কাউন্সিলে সবাইকে ভাবতে হচ্ছে পাঁচটি পদ নিয়ে। পদগুলো হলো, চেয়ারম্যান, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান, মহাসচিব ও প্রথম যুগ্ম মহাসচিব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপার শীর্ষ নেতারা বলেন, কাউন্সিল যতই ঘনিয়ে আসছে, পদ-পদবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ ততই বাড়ছে। রওশন এরশাদ চাইছেন তার মতামতের গুরুত্ব থাকুক কাউন্সিলে। যদিও তিনি চেয়ারম্যান পদ চাইছেন না। তবে সিনিয়র নেতারা মনে করেন, তার কর্তৃত্ব থাকুক দলে। পাশাপাশি জাপায় নতুন সমীকরণ
ছেলে সাদ এরশাদ দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকুক: তারা বলছেন, দলের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে আবারও ঝড় বয়ে যেতে পারে জাতীয় পার্টিতে। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলের হাল ধরতে পারেন স্ত্রী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ।চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে আনুষ্ঠানিকভাবে। কারণ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্ত্রী রওশন এরশাদ।
প্রয়াত স্বামীর মতোই দলটিতে তারও অবদান রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে স্বামীর সঙ্গে কারাগারেও ছিলেন। দশম ও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টিকে বিরোধীদলের আসনে অধিষ্ঠিত করার পেছনেও রয়েছে তার অগ্রণী ভূমিকা এমনটাই মনে করেন দলের শীর্ষ নেতারা।
এছাড়া দলের মধ্যে দুটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) চেয়ারম্যান হিসেবে মানতে নারাজ। তারা চান সিনিয়র হিসেবে রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান থাকুন। জিএম কাদের হবেন জাতীয় পার্টির নির্বাহী সভাপতি। তাতে দল হবে শক্তিশালী। সিনিয়র নেতাদের দাবি, এতে দল শক্তিশালী হবে। দলের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন জিএম কাদের এমন আভাস মিলিছে একটি সূত্র থেকে। কারণ তাতে দল গোছাতে বেগ পেতে হবে না তার। এ বিষয়ে দলের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকও করেছেন। সম্মেলনের আগেই রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এরশাদের অবর্তমানে পার্টিতে এখন তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দুটি পক্ষ এরশাদের পারিবারিক। অন্য পক্ষটি দলের শীর্ষ নেতাকর্মীদের নিয়ে। জিএম কাদের ও স্ত্রী রওশনের মধ্যে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে দু’পক্ষের বাইরে অন্য পক্ষটি। নিজেদের স্বার্থে একেক সময় একেক ঘাটে তরী ভেড়াচ্ছে। তবে দলের উভয় পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু আভাস মিলেছে, তা হলো আসন্ন জাতীয় কাউন্সিলে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সব পক্ষই চায় দল শক্তিশালী করতে। আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খুঁজে পাবে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
এ দিকে মহাসচিব পদেও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, এরশাদের ভাগ্নি জামাই সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, গোলাম মসীর, মুজিবুল হক চুন্নুর নাম নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল বাড়লে সম্মেলন পিছিয়ে যেতে পারে এমন আভাসও দিয়েছেন কয়েক নেতা। যদিও এখন পর্যন্ত জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের চেয়ারম্যান পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে জাতীয় সম্মেলনের ক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাপার এক জ্যেষ্ঠ নেতা।
জাপার এক শীর্ষ নেতা বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে দলে নিজের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের নানা কৌশলী পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যেতে পারে। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে ‘চেয়ারম্যান’ এবং জিএম কাদেরকে ‘নির্বাহী চেয়ারম্যান’ করার ফর্মুলা এখন জাপার অন্দর মহলে দায়িত্বশীল নেতাদের মুখে মুখে। ‘রওশন চেয়ারম্যান, জিএম কাদের নির্বাহী চেয়ারম্যান’ এ ফর্মুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমেই রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান ও জিএম কাদের নির্বাহী চেয়ারম্যান হচ্ছেন এটি এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে।’ জাপার গঠনতন্ত্রে ‘নির্বাহী চেয়ারম্যান’ পদ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এ নেতা বলেন, কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে পদটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এদিকে ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় কাউন্সিল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের খোলা চত্বরে প্রথম পর্ব হবে। সারা দেশ থেকে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট মিলিয়ে ৫০ হাজার প্রতিনিধির মিলনমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পদে আসতে আগ্রহী নেতারা সম্মেলনের মূল প্যান্ডেলসহ বাইরের সড়কে নিজ নিজ অনুসারীদের নিয়ে ব্যাপক শোডাউন করে শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সম্মেলনকে ঘিরে ব্যস্ত নেতাকর্মীরা। এদিকে দলের সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল রোববার বিকালে রওশন এরশাদের বাসায় যান দলের সিনিয়র নেতারা।
নতুনসময়/আইকে