ঢাকা রবিবার, ২০শে জুলাই ২০২৫, ৬ই শ্রাবণ ১৪৩২


পাহাড়ে ভয়ংকর আস্তানা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের


৬ আগস্ট ২০২২ ০২:৫৩

ছবি- সংগৃহিত

টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে পুলিশি তৎপরতা বাড়ায় ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ স্থানীয় বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গম ওই পাহাড়ি এলাকা থেকে তারা অপরাধমূল কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাদক চোরাচালানসহ স্থানীয় এবং রোহিঙ্গাদের অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব অপরাধীরা। সম্প্রতি বাহারছড়া এলাকা থেকে স্থানীয় চার জন অপহরণ হয়েছেন। আর এক মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০ জন। এসব ঘটনায় এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় পাঁচ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি আরসার (আগের নাম আল-ইয়াকিন) নাম ব্যবহার করে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, আরসার অস্তিত্ব নেই। অনেক সময় সাধারণ রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। গত এক মাসে বাহারছড়া এলাকায় সাত-আটটি অপহরণের ঘটনা ঘটে। প্রায় ১০ জন স্থানীয় লোক অপহরণের শিকার হন। তবে সব ঘটনার বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ পৌঁছেনি। স্থানীয়রা মুক্তিপণ দিয়ে স্বজনদের মুক্ত করেন।

এপিবিএন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের সাত মাসে রোহিঙ্গা শিবিরসহ টেকনাফের বাহারছড়া এলাকায় অর্ধশতাধিকের মতো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ অপহৃতকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর আটটি মামলায় ১০ জন অপহরণকারীকে গ্রেফতারও করা হয়। এর মধ্য বাহারছাড়া এলাকায় গত এক মাসে আটটির মতো অপহরণের ঘটনায় পাঁচ জন অপহরণকারী গ্রেফতার হয়েছে।

দেখা যায়, টেকনাফে থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরে বাহারছাড়ার পাহাড়ি এলাকায় নোয়াখালীপাড়ার অবস্থান। তার পাশে রয়েছে মারিশবুনিয়া, ডেইল পাড়া, বাঘগুনা ও কোনাপাড়া। এসব গ্রামে সাড়ে ২০ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের বসতি অধিকাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে। হঠাৎ অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এসব এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।

সর্বশেষ ৩১ জুলাই সকালে ওই এলাকায় মো. ইলিয়াছ ও সৈয়দ আহমদ নামে স্থানীয় দুই জনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এর আগের দিন নোয়াখালীপাড়ার মোহাম্মদ মুবিনুল ও মোহাম্মদ নূর নামে আরও দুই জনকে অপহরণের পর ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ মুক্তিপণ দাবি করে স্বজনদের কাছে।

তবে এসব ঘটনার অধিকাংশ মাদকের লেনদেনের কারণে ঘটছে বলে দাবি করেছেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বাহারছড়ায় অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তবে মাদক লেনদেনের কারণে ওই এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় স্থানীয়রা নিজেই এসব সমস্যার সমাধান করেন। যে সব ঘটনা পুলিশের কাছে আসে না।

স্থানীয় হুমায়ুন কবির ও মো. ইলিয়াছ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে এপিবিএনের অভিযান জোরদার হলে পাহাড়ে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা সেফজোন হিসেবে বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকা ব্যবহার করছে। এ কারণে হঠাৎ করে মাদক পাচারসহ অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। প্রতিনিয়ত তারা পাহাড়ে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। আমরা এখানে কেউ নিরাপদ নই। অনেকে রাতে ঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেন।

টেকনাফ বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, সম্প্রতি অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ গ্রামের ২০ হাজারের বেশি মানুষ ভয়-ভীতির মধ্যে রয়েছে। গত এক মাসে সাত-আটটির মতো ঘটনায় স্থানীয় ১০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে এপিবিএন-১৬-এর অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকায় সাত মাসে ৩০টি অপহরণের ঘটনায় দুই জন বাংলাদেশিসহ ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় পাঁচটি মামলায় সাত অপহরণকারীকে গ্রেফতারও করা হয়। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বেশির ভাগ অপহরণ মাদকের কারণে ঘটেছে।

এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদফতর সূত্র জানায়, তাদের অভিযানে ২০১৭ সালে ১৩, ২০১৮ সালে ৩০, ২০১৯ সালে ২৬, ২০২০ সালে ৯১, ২০২১ সালে ১৮৬ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে মাদক, টাকা ও সোনার বারসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যাতি চাকমা বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গারা এখন উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক বেচাকেনা ও বহনে ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি তাদের কাছ থেকে তিনটি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা শুধু মাদক বেচাকেনা ও বহনে সীমাবদ্ধ নয়; সোনা চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে।

দেড় কোটি টাকা মূল্যের সোনার বারসহ মা-ছেলেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানায়, গত ২৪ জুলাই ১৮ হাজার টাকার জাল নোটসহ তিন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়। নগরীর কোতোয়ালি থানার সিনেমা প্যালেস সংলগ্ন সৌদিয়া পরিবহনের কাউন্টার থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল কবির বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জাল টাকাসহ তিন রোহিঙ্গাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। আগে ইয়াবাসহ একাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জাল টাকাসহ গ্রেফতারের ঘটনা এবারই প্রথম। তারা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তিন রোহিঙ্গা পালিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিল বলে জানিয়েছে আমাদের। মাদক ছাড়াও হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছে তারা।

গত ২৯ জুলাই রাত ১০টায় সীতাকুণ্ড থানাধীন জঙ্গল সলিমপুরে অভিযান চালিয়ে দেড় কোটি টাকা মূল্যের সোনার বারসহ মা-ছেলেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তারা রোহিঙ্গা হয়েও মিথ্যা পরিচয়ে সলিমপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিল। তাদের কাছ থেকে আটটি সোনার বার, পাঁচটি চেইন, এক জোড়া বালা, তিন জোড়া কানের দুল, তিনটি আংটি ও চারটি লকেট উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত এসব সোনার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এর মধ্যে আটটি সোনার বারের মূল্য এক কোটি টাকা।

র‌্যাব বলছে, ইয়াবা বিক্রির লভ্যাংশ দিয়ে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে সোনার বার উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পগুলোতে পাচার করে আসছে। পরে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

র‌্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নুরুল আবছার বলেন, গ্রেফতার দুই রোহিঙ্গা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় তারা মিয়ানমার থেকে ২০১২ সালে বাংলাদেশে আসে। দীর্ঘদিন ধরে সলিমপুরে ভাড়া বাসায় থেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল তারা। গ্রেফতার আসমত উল্লাহ ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার ঈদগাহে অবস্থান করেছিল। ২০১৪ সালে এজেন্সির মাধ্যমে তার এলাকার চাচা আব্দুস সালাম তাকে পাসপোর্ট করে ভিসা দিয়ে সৌদি আরব নিয়ে যায়। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সৌদি আরব অবস্থান করেছিল। ২০২০ সালে অবৈধভাবে অবস্থান করায় সেদেশের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠায়। বাংলাদেশে আসার পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিয়ে করে ঈদগাহ এলাকা ছেড়ে স্ত্রী ও মাসহ সলিমপুর চলে আসে আসমত উল্লাহ। এতে বোঝা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে হাজারো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। আমরা খবর পেলেই অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করছি।