স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার লতিফের ‘হোয়াইট হাউজ’

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের শ্রীনগর মোড় থেকে বামপাশে দিয়ে চলে গেছে মুন্সীগঞ্জ সদর রোড। এই সড়কের টঙ্গীবাড়ি থানা এলাকার সুবচর্নী বাজারের হাতের ডান দিকে শিলিমপুর গ্রাম। ওই বাজারে গিয়ে আব্দুল লতিফ নামে এক যুবকের নাম বলতেই স্থানীয়রা বলে উঠলেন, হোয়াইট হাউজে যাবেন? প্রতিবেদক কিছুটা অবাক হলেও পরে তারা খোলাসা করে বলেন, ‘লতিফ এখানে আলিসান এক বাড়ি বানিয়েছে, যেটা হোয়াইট হাউজ নামে পরিচিত। এমনকি এই বাড়ির কল্যাণে তাকে এখন সবাই ‘হোয়াইট হাউজ লতিফ’ নামেই চেনে।
আব্দুল লতিফকে নিয়ে স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনেকটা চমকে ওঠার মতোই। তারা সবাই জানেন, লতিফ স্বর্ণের বড় কারবারি। কয়েক বছর আগেও তেমন কিছু ছিল না মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার শিলিমপুর গ্রামের যুবক আব্দুল লতিফের। এখন তিনি শতকোটি টাকার মালিক। কী করে বানালেন সম্পদের এই পাহাড়! মূলত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, স্বর্ণ চোরাকারবারীদের অন্যতম গডফাদার হিসেবে পরিচিত আব্দুল লতিফ। আইনের ফাঁক-ফোঁকরে আনা স্বর্ণ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যও তিনি। ব্যাগেজ রুলসের সুবিধায় কিছু ব্যক্তিদের ব্যবহার করে স্বর্ণ এনে তা পাচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদও গড়েছেন। শুধু নিজ এলাকাই নয়, গোয়েন্দাদের তালিকাতেও স্বর্ণকারবারির তালিকায় তার অবস্থান ওপরের দিকেই।
অল্প কিছুদিনেই আব্দুল লতিফ এলাকায় বানিয়েছেন কয়েকটি আলিসান বাড়ি। এর মধ্যে নান্দনিক ডিজাইনের সাদা রঙের একটি বাড়ি ‘হোয়াইট হাউজ’ নামে পরিচিত পেয়েছে। সব মিলিয়ে বিগত কয়েক বছরে লতিফের এমন সম্পদ ঠিক যেন আলাদ্দিনের চেরাগের মতই।
ইসহাক নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানালেন, বিগত কয়েক বছরে লতিফের ফুলেফেঁপে ওঠার গল্প রূপকথাকেও হার মানাবে। গ্রামে বড় বড় সব বাড়ি-ই লতিফের। এছাড়াও নিজ গ্রামে ছাড়াও পার্শ্ববর্তী লৌহজং থানার ঘাসবুক, গলিয়া খোলা, কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে বাড়িসহ গড়েছেন প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ। এছাড়াও ঢাকার সদরঘাটে গার্ডেন সিটিতেও ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
একরাম নামের আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, গ্রামের বিত্তশালীদের মধ্যে এখন সে-ই আলোচিত। কয়েক বছর আগেও তার এমন কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন তার সবই আছে। বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ; কী নেই তার! গ্রামের মধ্যে বাংলো বাড়িও তার নিজের। শুধু স্বর্ণের কারবার করে সে আজ এই অবস্থানে।
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘যদি এই ব্যবসা অবৈধ হলে লতিফকে পুলিশ ধরে না কেন?’ লতিফের হয়ে এই এলাকার অনেকেই কাজ করে বলেও জানান তিনি।
বাজার থেকে কিছুটা ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে লতিফের সেই কাঙ্ক্ষিত হোয়াইট হাউজ। ভবনটির ভেতরের কাজ এখনও কিছুটা বাকি, বাইরের দিকে কাজ প্রায় সব শেষ। গ্রামের মধ্যে এমন আলিসান বাড়ি দেখে যে কারোরই চোখ জুড়াবে। গ্রামের লোকজন বলছেন, এমন বাড়ি বানাতে কোটি টাকার ওপরে খরচ হয়েছে, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
গ্রামের ভেতরেই আরেকটি বাংলো বাড়ির আছে লতিফের। সেই বাড়িটিও কোটি টাকা খরচ করে বানানো বলে বলছেন স্থানীয়রা। গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, ধনসম্পদে লতিফ এখন অনেক ওপরে। শুধু স্বর্ণের কারবার করেই লতিফ আজ পায় শতকোটি টাকার মালিক।
তারা বলেন, কয়েকদিন আগেই তিনি দুবাই গেছেন। এখনও দেশে ফেরেনি। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে লতিফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি দুবাই থাকার কারণে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে অর্থাৎ প্রতি যাত্রী ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্সের বিনিময়ে একটি স্বর্ণের বার আনতে পারেন। এই সুযোগের পাশাপাশি বিমানবন্দরের কাস্টমসসহ অন্যান্য সংস্থার চোখ এড়িয়ে যারা স্বর্ণ দেশে আনেন সেই চক্রের অন্যতম সদস্য আব্দুল লতিফ। গত প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর ধরে তিনি এ কাজে জড়িত। প্রথম দিকে নিজে এই কারবারে জড়িত থাকলেও এক পর্যায়ে তার লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকার ব্যক্তি, এমনকি প্রবাসে থাকা লোকদেরও তার দলে ভেড়ান। স্বর্ণ বাহকের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে কাজ করান তিনি। বর্তমানে প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি তার এই দলে কাজ করেন। কখনও ট্যাক্স দিয়ে, আবার কখনও বিমানবন্দরের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে স্বর্ণ আনাই তাদের কারবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রের কাজ হলো ব্যাগেজ রুলসের সুবিধায় একটি করে স্বর্ণের বার আনা। তারা এই বারগুলো তুলে দেন লতিফের কাছে। দেখা যায়, দুই বা তিন দিনের মধ্যে লতিফের ১০ থেকে ১২ জন লোক চলে আসে। তার লোকদের হাতে আসা বারগুলো নিয়ে তিনি পাচারকারীদের দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দেন।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, এরা যে শুধু বাহকের মাধ্যমে করে তাও নয়। অনেক সময় এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে হাত করেও স্বর্ণ আনে। অর্থাৎ সুযোগ যখন যেভাবে পায়, তখন সেভাবে স্বর্ণ আনে। দেশে এই কারবারের সঙ্গে জড়িত হিসেবে যাদের তথ্য রয়েছে, তার মধ্যে আব্দুল লতিফের নাম অন্যতম শীর্ষে। স্বর্ণ চোরাকারবারীর হোতাদের মধ্যে অন্যতম সে।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিনহাজ উদ্দিন বলেন, কাস্টমস আইনে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো না। বিমানবন্দরে আসার সময় তার কাছ থেকে স্বর্ণ পেলে গ্রেফতার হলে তখন ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, তিনি যেহেতু এখন অনেক সম্পদের মালিক। তার স্ট্যাটাসের সঙ্গে এগুলো যেহেতু অসঙ্গতিপূর্ণ, সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে ইনকাম ট্যাক্স কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের যুগ্ম কমিশনার (বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. আল আমিন বলেন, কোনও প্রবাসী বা কোনও যাত্রী যদি একটি স্বর্ণের বারের ট্যাক্স পরিশোধ করে দেশে নিয়ে আসেন, এক্ষেত্রে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। আমাদের বিষয়টি হলো, তিনি কাস্টমস হলে সোনার বিষয়টি ডিক্লেয়ার করেছেন কিনা, কর পরিশোধ করেছেন কিনা। যদি করে থাকেন, তিনি বৈধভাবে আনতেই পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক যাত্রী যদি একটি করে সোনার বার নিয়ে আসেন, তারা ট্যাক্স পরিশোধ করছেন কিনা, এটা দেখা পর্যন্তই আমাদের কাজ। পরবর্তী সময়ে তিনি ওই বার কী করলেন বা কী কাজে ব্যবহার করলেন; এটা আমাদের নিকট কোনও বিবেচ্য বিষয় না। এটি দিয়ে যদি কোন অপরাধ বা দেশের বাইরে পাচার করে বা করতে চায়; সেটি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলার বিষয়। আর যেহেতু তার অন্য বিষয়ও রয়েছে, সেহেতু এ বিষয়টি দুদক কিংবা ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট খতিয়ে দেখতে পারে।