হলি আর্টিজান হামলার নেপথ্য

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ২ নম্বরে হলি আর্টিজান বেকারি সাক্ষী হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম এক নৃশংস জঙ্গি হামলার। বিকৃত মতাদর্শের কিছু মানুষের পরিকল্পনায় বিপথগামী কয়েকজন তরুণ এর কুশীলব।
পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ইফতারের পর অন্যান্য দিনের মতো রাজধানীবাসী সেদিনও প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারাবির নামাজ আদায়ের। ঠিক এ সময়ে ঘৃণ্যতম এক নরহত্যার সূচনা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি’র এই সদস্যরা।
হলি আর্টিজান বেকারিতে খাবার খেতে আসা দেশিবিদেশি নাগরিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনায় হতবাক করে দেয় বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে। জনমনে আশঙ্কা জাগে বাংলাদেশ কি তবে হতে যাচ্ছে ভয়াল জঙ্গিবাদের আরেকটি উত্থানমঞ্চ? সোমবার সেই হামলার আট বছর পূর্ণ হলো।
ফিরে দেখা বিভীষিকা : নিস্তরঙ্গ গুলশান লেকের পাড়ে হলি আর্টিজান বেকারি চত্বরে সেদিন খোশগল্পে মেতে ওঠা অতিথিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণে যেন ভয়াল রাত নেমে আসে। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে বাতাস ভারী করে তোলে হতভাগ্যদের কান্না আর ভয়ার্ত আর্তনাদ। সেদিন হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে হামলাকারীদের নৃশংসতার বলি হয় দেশি-বিদেশি মোট ২০ জন নাগরিক। এদের প্রত্যেককেই কুপিয়ে জখম করে অথবা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার পর গলা কেটে ফেলে হামলাকারীরা। নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে মারা যায় ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, ১ ভারতীয়, ১ বাংলাদেশি/আমেরিকান এবং ২ বাংলাদেশি নাগরিক।
রাতভর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ অভিযানে উদ্ধার হওয়া জীবিত ৩২ জন। এর মধ্যে প্রথমে পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয় ২ জন বিদেশিসহ ১৯ জন। এরপর সেনাবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হয় দেশি-বিদেশি মোট ১৩ জন।
পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ অভিযানে হামলাকারীদের বোমার আঘাতে নিহত হয় ডিবি’র এসি রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২। এছাড়া গুরুতর আহত হয় পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকে।
যেভাবে হয়েছিল হামলার ছক : কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের তদন্তে উঠে এসেছে হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনার পুরো ছক। গোয়েন্দা তথ্যসূত্র মতে, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পরিকল্পনা করা হয় রাজধানী ঢাকায় এমন একটি বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর, যাতে করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায় এবং একই সাথে বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে সেটিও প্রমাণ করা যায়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্যাডার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমে ঢাকার ৩ তরুণকে বাছাই করা হয়, যাদের ঢাকা শহর সম্পর্কে ধারণা আছে। শেষ পর্যন্ত যাতে নিষ্ঠুরতার মাত্রা ধরে রাখা যায় সেজন্য আরো ২ জন গ্রামের ছেলেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের অতীতেও অপরাধের রেকর্ড আছে। ঢাকায় হামলা করার জন্য এ ৫ জনকে গাইবান্ধায় নিয়ে গিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ। গাইবান্ধার চর এলাকার একটি ক্যাম্পে ২৮ দিনের এ প্রশিক্ষণে মূল প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে জাহিদ (পরবর্তী সময়ে রূপনগরে সোয়াটের অভিযানে নিহত)।
প্রশিক্ষণ শেষে তারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ ঢাকার কয়েকটি স্থানে সাময়িকভাবে অবস্থান করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে গুলশান-বারিধারার সুবিধাজনক এলাকায় টার্গেট বাছাইয়ের কাজ। এক পর্যায়ে হামলার উপযুক্ত টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান বেকারিকে। বেকারিটি হামলার উপযুক্ত টার্গেট হওয়ার মূল কারণ, এটিতে ব্যাপক সংখ্যক বিদেশি অতিথির আনাগোনা ছিল। আর শুক্রবার এ আনাগোনা থাকতো সবচেয়ে বেশি। টার্গেট চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ গত বছরের ১ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যার পর হলি আর্টিজান বেকারিতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়। তারপরের ঘটনা সবার জানা।
সিসি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, হামলাকারীরা বসুন্ধরা এলাকার বাসা থেকে প্রথমে রিকশা এবং পরবর্তী সময়ে পায়ে হেঁটে হলি আর্টিজানে হামলা চালাতে আসে। এ সময় তাদের কাঁধে ব্যাগ আর পরনে ছিল টিশার্ট-জিনস-কেডস। আউটফিট এমন ছিল যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত পালিয়ে আসা যায়। তদন্তের সূত্রগুলো বলছে, হামলাকারীরা সঙ্গে করে নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে যায়নি। যতক্ষণ তারা হলি আর্টিজানের ভেতরে ছিল ততক্ষণ তারা ভিকটিমদের মোবাইল ফোন/আইপ্যাড ব্যবহার করে ছবি তুলে মিরপুরের শেওরাপাড়ায় অবস্থানরত তামিম চৌধুরী এবং নুরুল ইসলাম মারজানের (উভয়েই পরবর্তী সময়ে সোয়াট ও পুলিশের আলাদা অভিযানে নিহত) কাছে পাঠায়। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক থেকে দেখা গেছে, এই অপারেশনটি ছিল তাদের একটি Low Cost অপারেশন, যেখানে ৮/৯ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়নি। অর্থের মূল যোগানদাতা ছিল তানভীর কাদেরী (পরবর্তী সময়ে আজিমপুরে সোয়াটের অভিযানে নিহত)।
তানভির কাদেরী পেশায় একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী খাদিজা (আজিমপুরে সোয়াটের অভিযানে গ্রেফতার) একটি মাল্টিন্যাশনাল এনজিওর কর্মী। এদুজন তাদের কথিত ‘হিজরত’-এর আগে নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট এবং গাড়ি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ জঙ্গি অপারেশনের জন্য গঠিত কমন ফান্ডে জমা দেন। এভাবেই হলি আর্টিজানে হামলার জন্য যোগান হয় অর্থের। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরকগুলোর মূল যোগান আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত দিয়ে। এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান (পরবর্তী সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হওয়া)।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী হলি, আর্টিজানে হামলার সময় হামলাকারীদের শরীরে কোনো ধরনের ড্রাগ বা রাসায়নিক বস্তুর প্রভাব ছিল না। যৌথ অভিযানে নিহত ৬ জনের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা শেষে এ প্রতিবেদন পাঠানো হয় বাংলাদেশ পুলিশের কাছে।
ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ : হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার রেশ বুঝি থামিয়ে দেবে উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে বিদেশি বিনিয়োগ- বিশ্ব মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো এমন হাজারও আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে একেবারেই সময় নেয়নি বাংলাদেশ।
দেশেজুড়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াট টিমের একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযান ব্যর্থ করে দিয়েছে জঙ্গিদের নাশকতার প্রচেষ্টা। এখন পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, জাহিদ, তানভীর কাদেরীসহ মোট ৫৭ জন জঙ্গি।
সংশ্লিস্টদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও নজরদারির পরিপ্রেক্ষিতে সংঘবদ্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ না পাওয়ায় জঙ্গি সংগঠন নব্য জেমবি’র কার্যক্রম এখন অনেকটাই স্থবির। তবে এখনো একেবারে এই সংগঠনটির কার্যক্রম থেমে গেছে বলা যাচ্ছে না। আবার কোনো এক সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আর কোনো রক্তাক্ত অধ্যায় যাতে রচনা করতে না পারে, সেজন্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি রেখেছে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ‘সোয়াট’ টিম। এলক্ষ্যে প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কঠোর নজরদারি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যেখানে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক বড় বড় নাশকতার ঘটনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্যকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছে বিশ্ব মিডিয়া।
বিপর্যয় পেছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো এমন দুঃসাহসী বাংলাদেশের স্বপ্নই তো এতদিন দেখেছে বাংলাদেশ।