ঢাকা সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২

খুনের পর খুন ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রভাবশালীরা


২৭ আগস্ট ২০২২ ০৩:৩৬

নিহত আলামিন (ফাইল ছবি)

২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা বা সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে চাঁদাবাজ রাশেদ কাজী হত্যাকাণ্ড, সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটেছে এ বস্তিকে কেন্দ্র করে।

বলছি কড়াইল বস্তির একের পর এক খুনের ঘটনা। দলীয় অভ্যন্তরীন দ্বন্দ বা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব খুনাখুনি। এর বাইরেও বস্তিটিতে মাদক ব্যবসা, দেহ ব্যবসা থেকে শুরু করে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করেও ঘটেছে অনেক হত্যাকান্ড। অপরাধের আখড়া হিসেবে পরিচিত কড়াইল এ বস্তিকে গত ১৭ আগষ্ট আলামিন হত্যাকান্ড নিয়ে নড়ে চড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

চাঁদাবাজির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনার তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বস্তিটিকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে হত্যার ঘটনায় এবারে নেপথ্যের নায়কদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ শুরু করেছে। আর এ কারণে বিগত সময়গুলোর হত্যা মামলার সর্বশেষ কি অবস্থা তা নিয়েও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আর এতে করে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা কাদের খান, কাশেম, আজাদ, মাসুদ, যুবলীগ নেতা মোস্তফা ফেঁসে যেতে পারেন।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলছেন, আলামিন হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা রিমান্ডে রয়েছে। শুধুমাত্র হত্যাকান্ড নয় পুরো বস্তির অনিয়মের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, যারা বস্তির মধ্যে না থেকেও বস্তি নিয়ন্ত্রন করেন তাদের ব্যাপারেও আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরও কোন ত্রুটি পাই সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নেব।

নিহত স্বজনদের আহাজারি

সরেজমিন জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। আয়তনে ১১৭ একর। আর সেই ভূখণ্ডে বসবাস ৬৪ হাজার পরিবারের। দরিদ্র শ্রেণির এই মানুষগুলোকে নিয়ে প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী খেলছে।

এদের ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোর বেপরোয়া মিশনে ব্যস্ত গোষ্ঠীর সদস্যরা। প্রায় সোয়া তিন লাখ মানুষকে জিম্মি করে মাসে চার কোটি টাকা ঘরে তুলছে। আর এই অবৈধ বাণিজ্য ঘিরে গত সাত বছরে অন্তত অন্তত ১০ জনের প্রাণ গেছে।

সিন্ডিকেটটি পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিয়ে বস্তিবাসীর কাছ থেকে আদায় করছে দ্বিগুণের বেশি বিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কেউ দেখায় না। এ টাকার ভাগ নিয়মিত পৌঁছে যায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, পুলিশসহ নানা সংস্থার লোকজনের কাছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ব্যবহৃত হয় মাত্র। তাদের নাম সবাই জানলেও আড়ালে থাকেন গডফাদাররা। অবৈধ লাইন কাটতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজনকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বেলতলা ও কড়াইল মৌজায় টিঅ্যান্ডটির ১১৭ একর জমি দখল করে ১০ হাজারেরও বেশি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বস্তিতে থাকে তিন লাখ ২৫ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে ভোটার ৪৫ হাজার।

দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। জ্বলছে গ্যাসের চুলাও। বস্তিবাসী জানায়, প্রতি মাসে ১৫০ টাকার বিনিময়ে একটি বাল্ব জ্বালাতে পারে তারা। একটি ফ্যানের জন্য লাগে ১৫০ টাকা। কোনো কিছু ব্যবহার না করলেও টাকা ঠিকই দিতে হয়। না দিলে সিন্ডিকেটের লোকজন লাইন কেটে দেয়। পরে সংযোগ পেতে অনেক ঝামেলা ও টাকা খরচ করতে হয়। ফলে বেশি বিল নিলেও তারা মুখ বুজে থাকে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, বস্তিবাসীর কাছ থেকে মাসে বিদ্যুতের বিল বাবদ নেওয়া হয় এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রতিটি গ্যাসের চুলার জন্য দিতে হয় ৬০০ টাকা করে। বস্তিতে ১২ হাজার চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চুলা থেকে প্রতি মাসে উঠছে ৭২ লাখ টাকা। পানির জন্য নেওয়া হয় মাসে এক কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে মাসে উঠছে চার কোটি টাকার মতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তিতে যাঁরা এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তাঁরা সরাসরি ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে টাকা তোলেন না। এ জন্য তাঁদের আলাদা লোক আছে। ফলে নেপথ্যের লোকদের সম্পর্কে জানে না বস্তির বেশির ভাগ মানুষ। আর যারা জানে, তারাও মুখ খোলার সাহস পায় না।

বস্তিবাসী জানায়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির টাকা আদায় নিয়ে প্রায়ই গণ্ডগোল হয়। খুনের ঘটনাও ঘটে। গত সাত বছরে দুলাল, বশির, মোশারফ, আলামিনসহ ১০জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে হত্যা করা হয় দুলাল সর্দারকে। এর আগে বশির খুন হন। ২০১১ সালে নিহত হন মোশারফ নামে আরো একজন। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। আর এ কারণে খুনিরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় বস্তিতে। সবশেষ আলামিন হত্যার শিকার হয়। ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্ষোভে ফুঁসছেন অনেকে।

তারা বলছেন, ঘটনার পর থেকে এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়েছে। পক্ষ বিপক্ষ গ্রুপ অস্ত্রেও মহড়াও চালাচ্ছে।

আলামিন হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, কড়াইল বস্তিতে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফিরে ফিরে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে বলে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা বা সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ রাশেদ কাজী হত্যাকাণ্ড, সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটেছে এ বস্তিকে কেন্দ্র করে।

তিনি বলেন, এসব হত্যা মামলার সর্বশেষ কি অবস্থা আমরা সেটি দেখবো। পাশাপাশি এসব হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহনকারী ছাড়াও এদের নেপথ্যে কারা তাদের ছাড় দেয়া হবেনা। কার গ্রুপ কিসের গ্রুপ গ্রুপের প্রধান কে সব বিষয়েই অনুসন্ধান হবে এবং আইনের আওতায় আনা হবে।


খুন, কড়াইল বস্তি, ডিবি পুলিশ, হত্যা, আধিপত্য, মাদক ব্যবসা, অপরাধ