গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মের নামে গুজব ছড়িয়ে আবারো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। জাতির পিতার ১০১ তম জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালনের সময় তারা বিভিন্ন গুজব সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ ও কুয়াকাটায় এমন গুজব সৃষ্টি করে হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গুজবকে ব্যবহার করে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করতে একটি চক্র তৎপরতা চালাচ্ছে। তাই এমন তৎপরতা রোধে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাবের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনও গতকাল বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের শাল্লা পরিদর্শন শেষে গুজবে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার সুনামগঞ্জের দিরাই পৌর শহরের স্টেডিয়াম মাঠে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত শানে রিসালাত সম্মেলন হয়। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ইসলামের বিরোধিতাকারীরা কখনো টিকে থাকতে পারেনি। ইসলামের দুশমন আবু জাহেল নবীজির বিরোধিতা করে টিকতে পারে নাই। তিনি আরো বলেন, নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। যারা নবীর নামে কুৎসা রটনা ও বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে সংসদে আইন পাসের মধ্য দিয়ে শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
এই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকও উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। এরই জের ধরে স্থানীয় যুবক ঝুমন দাস আপন মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে অশালীন মন্তব্য করেন। পরে হেফাজতের লোকজন প্রতিবাদ করলে পুলিশ তাকে আটক করে। বিষয়টি সেখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে একটি চক্র ফেসবুকে নানা উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে পরদিন সকাল ৮টার দিকে নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। কয়েক ঘণ্টার পর ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
স্থানীয়রা বলছেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে তারা এই হামলা করেছে। এসময় ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।
এছাড়া গত বুধবার রাতেও কুয়াকাটা সফররত চরমোনাইয়ের পীরের ওপর হামলা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ খবরে সেখানে তার অনুসারীরা জড়ো হতে থাকে। এক পর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সোহরাব হোসাইন বলেন, রাত ১২টার দিকে সৈকত এলাকায় পর্যটক বাবু নামের এক যুবকের সাথে হাতাহাতি হয় চরমোনাইয়ের কয়েকজন ভক্তের। আমরা ওই যুবককে আলাদা করে পুলিশ বক্সে নিয়ে আসি। এরই মধ্যে বেশ কিছু লোক জড়ো হওয়ায় ওই যুবককে থানায় পাঠানো হয়।
মহিপুর থানার ওসি মনিরুজ্জামান জানান, আটক রফিকুজ্জামান বাবুকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সে মানসিক রোগী। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের শাল্লায় ঘটনাস্থলে যান র্যাবের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, শাল্লার ঘটনা, জঘন্য ঘটনা। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্িষকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময় নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা চরম নিন্দনীয়। হামলা যে বা যারাই করুক না কেন র্যাব তা বরদাশত করবে না।
পরে নোয়াগাঁও গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। পুরো সময়জুড়ে তিনি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শন করেন। পরে নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি গ্রামবাসীদের বলেন, শাল্লায় এমন ঘটনা ঘটবে আমরা প্রত্যাশা করিনি। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে র্যাবকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতার আহ্বানও জানান।
সূত্র মতে, বর্তমানে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০ দিনর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চলছে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রধানদের আসার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট সফরে রয়েছেন। অনেক বিদেশি অতিথিও রয়েছেন। এরই মধ্যে একটি চক্র গুজবকে ব্যবহার করে অস্থিতিশিল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলারও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একটি চক্র এ ধরনের সুযোগ নিয়ে থাকে। বর্তমানে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সতর্কতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠছেনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলো সতর্ক রয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, র্যাবের একটি দক্ষ সাইবার মনিটরিং টিম রয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক সব সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি করছে। যদি কেউ গুজব সৃষ্টির চেষ্টা করে তাকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। এছাড়াও সাধারণ মানুষ যে কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে র্যাবের ভেরিফাইড পেজে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। পাশাপাশি জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে যাতে কোনো ধরনের গুজবে কান না দিয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই করে।
এরআগেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা ছিল গুজবনির্ভর।
গত বছরের ১৮ এপ্রিল গুজব ছড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় গরুবাহী কাভার্ড ভ্যান চুরি সন্দেহে পুলিশের উপস্থিতিতে এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলে জনতা। আর মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ২৫ এপ্রিল নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে তুচ্ছ ঘটনার জেরে সুমন নামের এক তরুণকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে আবু ইউনুছ মো. জাহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর তাঁর লাশও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে খুলনায় ১০ জন, ঢাকায় ৯ জন, রাজশাহীতে তিন, রংপুরে এক, চট্টগ্রামে পাঁচ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুজন নিহত হয়েছে গণপিটুনিতে। ২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫। ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩৯ জন।
পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে, তাই মানুষকে গুম করা হচ্ছে এমন গুজবে গত জুলাইয়েই পিটিয়ে মারা হয় ১৭ জনকে। ২০ জুলাই রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাছলিমা রেনু নামের এক নারী। এই ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছিল।
এর আগে বেশ কয়েকবার কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ধর্মের নামে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ। ওই দিন রাত ২টার পর বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ায় যে, সরকার সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দিয়েছে। এরপর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। তারা মসজিদের মাইকে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে ধর্মভীরু জনগণকে ঘর থেকে ডেকে বাইরে আনে। ফজরের নামাজের পর লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জামায়াত ও বিএনপি-র শত শত সন্ত্রাসী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাণিজ্য মেলা, স্টেশন, সদর থানা, ফুলবাড়ি, উপশহর, নারুলী, কৈগাড়ি ও স্টেডিয়াম ফাঁড়ি, মোকামতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া, সদর থানার অস্ত্রাগার ও আশপাশের মার্কেটগুলোতে লুটপাটের চেষ্টা করে।