কারাগারে বসে ভয়ংকর হামলার ছক নিষিদ্ধ হুজির

কারাগারে বসে ভয়ংকর হামলার ছক কসছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ। বন্দি হুজির শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহর নেতৃত্বেই সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে তারা। নানা রকম ছদ্মবেশে থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক কমান্ডার নির্বাচিত করে ঝিমিয়ে পড়া সংগঠনের সদস্যদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। এমনকি বিভিন্ন সময় অন্যান্য জঙ্গি সংগঠণের সদস্য বর্তমানে যারা নিষ্ক্রিয় তাদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ ৩ নেতাকে গ্রেফতার করে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গ্রেফতারকৃতরা হলো -মোঃ মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান, শেখ সোহান স্বাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। এ সময় তাদের নিকট হতে ১ টি প্রাইভেটকার, ৫ টি মোবাইল ফোন, ১ টি মাইক্রোফোন, ১ টি চাপাতি, ২ টি ছোড়া, ১০ টি ডেটোনেটর, ১৭০ টি বিয়ারিং লোহার বল, ১ টি স্কচটেপ, ৫ লিটার এসিড, ৩ টি আইডি কার্ড ও ১ টি জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, তারা “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী”এর সক্রিয় সদস্য। তারা মাইনুল ইসলাম এর নেতৃত্বে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী পুনর্গঠন, পূর্ণাঙ্গ শুরা কমিটি প্রস্তুত করণ, সংগঠনের অর্থ দাতা এবং সদস্যদের নিকট থেকে অর্থের যোগান নিশ্চিত করণ, ব্যাপক হারে সংগঠনের রিক্রুটমেন্ট করণ, অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ, কারাগারে আটক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের জামিনের ব্যবস্থাকরণ, বান্দরবান-নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় জমি লিজ নিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার কাজে নিয়োজিত ছিলো। তারা বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় তাদের সংগঠনের বিস্তার ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন পরিচয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা কারাগারে আটক ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর ও ২০০০ সালের কোটালিপাড়ায় তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানের নির্দেশে সাংগঠনিক কাজ করছিলো।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত মাইনুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবত নিষিদ্ধ সংগঠন হুজি’র প্রধান অপারেশন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলো। সে সাংবাদিকতার বেশ ধারণ করে সংগঠনের দাওয়াতি কাজ, অর্থ সংগ্রহ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করে আসছিলো। তার পরিকল্পনা ছিলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরে বড় ধরনের নাশকতা করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা। সে ২০১৫ সালে হুজি’র শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলো।
সাইফুল ইসলাম বলেন, অপর গ্রেফতারকৃত সোহান স্বাদ সুনামগঞ্জ’র বিবিয়ানা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। সে ঢাকায় মিরপুর বাংলা কলেজে পড়ার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতো। ২০১৬ সালে একুশে বই মেলায় নাশকতার ঘটনায় গ্রেফতার হয়। এছাড়াও সে ২০১৭ সালে বিষ্ফোরক মামলায় এবং ২০১৯ সালে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়। জামিনে বের হয়ে সে মাইনুলের নেতৃত্বে হুজির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতো। গ্রেফতারকৃত মুরাদ হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’র সক্রিয় সদস্য। সে ব্যবসার আড়ালে হুজি সংগঠনের দাওয়াতি ও বায়তুল মালের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতো।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল রাজশাহীতে আটক হয়। আটকের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশে সংগঠনের যে বিস্তার ঘটেছে তাতে কিছু আঞ্চলিক নেতার নাম পেয়েছে পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, হুজির আঞ্চলিক কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল ও আব্দুল আজিজকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা পুরো এই গ্রুপকে গ্রেপ্তারে কাজ করছি।
গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মতে, বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যখন কোনো পরিকল্পনাতে তারা এগোনোর চেষ্টা করে, তখন তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এরই মাঝে হরকাতুল জিহাদও এরকম এক চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। কারাগারে আটক হুজির শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহ এই গ্রুপকে নির্দেশনাও দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে তারা দল গোছানোরও কাজ করছে।
সূত্র জানায়, যেহেতু তারা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনকে মনোনীত করেছে, সেহেতু গোয়েন্দাদের ধারণা, অন্যান্য বিভাগেও তারা কোনো একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মনোনীত করেছে। এরই মধ্যে রাজশাহীতে কর্মী সম্মেলন করতে গিয়েই আটক হয় দায়িতপ্রাপ্ত ইব্রাহিম খলিল ও তার সহযোগী।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাইনুল ও ইব্রাহিম খলিলের মতো সারা দেশে এরকম ৮ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা নির্বাচিত হয়েছে হুজির। তারা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠতে চায়। বিভিন্ন সময়ে তাদের দলে থাকা কর্মীদের ডাকাও হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে থাকা কর্মীদের দলে ভেড়াতে চাচ্ছে তারা। বিশেষ করে কারাগারে বন্দি শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহসহ অন্যান্য নেতাদের মুক্ত করতে তহবিলও সংগ্রহ করছে। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে এ টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কারাগার থাকা অন্যান্য নেতাদের নির্দেশে হামলার ছক আঁকছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, কারাগার থেকেই মূলত আতিকুল্লাহ এসব দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তার এ দিকনির্দেশনা অনুসারে কাজ করছে তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, আপাতত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করার ওই রকম শক্তি নেই হুজির। শুধু হুজি নয়, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের আছে বলে মনে হয় না। এর আগে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ এবং বগুড়ায় নব্য জেএমবি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদেরও আটক করা হয়েছে। সব মিলিয়ে জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়ানোর চেষ্টা করছে, এটা আমরা বুঝছি। তারপরও আমাদের নজর এড়ানো কঠিন। জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেই পদক্ষেপগুলো রয়েছে।
কে এই আতিকুল্লাহ
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, আতিকুল্লাহ ১৯৯৬ সালে মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে গঠিত হুজিবি’র কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। পরে সে বায়তুল মাল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্বশীল হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথমদিকে আতিকুল্লাহ দুবাই হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যায়। সেখান থেকে একাধিকবার সে পাকিস্তান গিয়ে দেশটির জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেসব বৈঠকে বাংলাদেশে হুজিকে সচল করার নানা পরিকল্পনা করা হয়।
জানা যায়, সে আশির দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়। সে বোমা তৈরিতে বিশেষভাবে দক্ষ। ওই সময় সে আল-কায়েদার প্রয়াত প্রধান ওসামা বিন লাদেন, তালেবানের সাবেক শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমরসহ আল-কায়েদার বর্তমান নেতা আইমান আল জাওয়াহেরির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। গত বছরের মার্চে সে দেশে এসে নতুন করে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশকে সংগঠিত করার কাজে নামে। এরই মাঝে তাকে গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির সিটিটিসি ইউনিট।
গ্রেপ্তারের আগে সে নতুন-পুরনো অনেক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া সে জেলে থাকা হুজিবি সদস্যদের জামিনে বের করে আনার জন্যও তৎপর ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তার তৎপরতা ছিল। রোহিঙ্গা ও কাশ্মীর ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সে নতুন সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছিল।
এক কর্মকর্তা জানান, হুজিবি সংগঠিত করতে আতিকুল্লাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করেছে বলে স্বীকার করে। এছাড়া দেশি সমর্থক ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা হুজিবি সমর্থকদের কাছ থেকে সে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিল। তার সঙ্গে পাকিস্তান, দুবাই ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক জঙ্গিদের যোগাযোগের তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায় ওই সময়।