ঢাকা শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


ইফতারীতে তৃপ্তিতে অপরিহার্য বগুড়ার সাদা দই


২৭ মার্চ ২০২৪ ১৬:২৩

ছবি : নতুন সময়

সারাদেশের মধ্যে অনন্য স্বাদ, মান, জনপ্রিয়তা আর সুখ্যাতিতে বগুড়ার দই- এখন সবচেয়ে এগিয়ে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় দইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে।

বগুড়ার বিখ্যাত সেই সরার দই গত ২৫ জুন ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দই রমজান মাসেও খাবারের কথা উঠেছে। দইয়ের প্রিয়তা আর কমলো না। বগুড়ায় ইফতারে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাদা দই।

অতিথি আপ্যায়নে দই বিকল্প নেই বলেই বগুড়ার দই দিন দিন হয়ে উঠেছে আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। রমজান মাস ছাড়াও যেমন চাহিদা ঠিক তেমনি রমজান মাসেও চাহিদা রয়েছে দইয়ের। দিনভর রোজা পালন শেষে ইফতারীতে অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠছে বগুড়ার দই। ঠান্ডা শরবত ঘোল পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। মিস্টি দইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চাহিদা বেড়েছে সাদা দইয়ের।

বগুড়া রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বগুড়ার সরার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে বগুড়ার দই বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে এটির মর্যাদা যেমন বাড়বে, তেমনি রপ্তানিতেও সুবিধা মিলবে। জিআই স্বীকৃতি এই পণ্যের মান দাম নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

বগুড়াকে দই শহর বলা হয়। তবে শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। কথিত আছে, গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকের দিকে গৌর গোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ি প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারনা ছিলোনা। গৌর গোপালের এই দই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার সাতানী পরিবারের কাছে দই সরবরাহ করতেন গৌর গোপাল। সে সময়ে এই দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। কালে কালে দিন গড়িয়ে গেলেও এখন বিশেষ খাবার হিসেবে জায়গা ধরে রেখেছে দই।

বগুড়ার পারিবারিক অনুষ্ঠানে দই একটি অভিজাত খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে আসছে বহু যুগধরে। দই শুধু সুস্বাদু নয়, শরীরের জন্য ওষুধ হিসেবে কাজ করে বলে এর জনপ্রিয়তা বেশি। মুলত মিস্টি এবং সাদা বা টক দই হিসেবে বিক্রি হয়ে থাকে। সারা বছরই দুই প্রকার দইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

অন্যান্য দিনের চেয়েও কোন কমতি নেই রমজান মাসেও। চলতি রমজান মাসেও ইফতার সামগ্রীতে দই অন্যতম হয়ে উঠেছে। সারা দিন রোজা পালন শেষে ইফতারে পিপাসা পেটাতে সাদা দই দিয়ে ঘোল এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাপদাহের এই সময় বেড়েছে দইয়ের চাহিদা। মুল্য বৃদ্ধির মধ্যেই রমজানের প্রথম দিনেই বগুড়ায় ইফতারের দোকানগুলোতে সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়।

বর্তমানে বগুড়া শহরের এশিয়া সুইট মিট দই ঘর, চেলোপাড়ার কুরানু, নবাববাড়ীর রুচিতা, কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া, মিঠাই, বিআরটিসি মার্কেটে রফাত দইঘর, দইবাজার, মিষ্টিমহল, সাতমাথায় দইঘর, মহরম আলী, শেরপুর দই ঘর, চিনিপাতাসহ অর্ধশত শো রুমে দই বিক্রি হচ্ছে।

আবার শহরের বাইরে বাঘোপাড়ার রফাত দই ঘর, শেরপুরের রিপন দধি ভান্ডার, সাউদিয়া, ফুডভিলেজ দই, জলযোগ, বৈকালী শুভ দধি ভান্ডার থেকে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হয়। এসব দইয়ের দোকানগুলোতে রোজাদার ব্যক্তিরা ইফতারের জন্য সাদা দই কিনছে।

রমজান মাসে দুপুরের পর থেকে শহরের দইয়ের দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাতের ভাড়ের সাদাদই (চিনিছাড়া) কিনতে মানুষ ভীড় করে থাকে। বিকেলের মধ্যেই সাদা দই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাদা দইয়ের সাথে বিক্রি হচ্ছে মিস্টি দইও। দইয়ের দোকানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় সাদা দই বিক্রি হচ্ছে। আর ফুটপাতে আকার ভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকায় সাদা দই বিক্রি হচ্ছে। রোজাদার ব্যক্তিদের জন্য দই এখন ইফতারে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে আছে।

বগুড়া শহরের কাটনারপাড়ার এলাকার বাসিন্দা ইনছান আলী শেখ জানান, গ্রীষ্মকালিন সময়ে রোজা রেখে ইফতারে ঠান্ডা কিছু হলে তৃপ্তি বেশি পাওয়া যায়। শরীর ঠান্ডা রাখতে অনেকেই দইয়ের ঘোলের উপর আস্থা রাখেন। কেউ বিভিন্ন প্রকার শরবত ব্যবহার করে।

কিন্তু, বগুড়ার দইয়ের বিকল্প হয় না। সাদা দই ঘোল করে পান করলে শারীরিকভাবে তৃপ্তি পেলে। আর যদি ইফতারে আপনি বেশি পরিমানে খেয়ে ফেলেন তবে মিস্টি দই আপনার হজম শক্তি বাড়িয়ে দেবে। সাদা মিস্টি দই ইফতারে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

দই বিক্রেতা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রোজার মাসে দই বেশি বিক্রি হচ্ছে সাদা দই। ক্রেতাদের চাহিদার বিপরীতে সাদা দই ক্রেতাদের মাঝে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

মহরম দই ঘর এর স্বত্ত্বাধিকারী মানিক জানান, সারাবছর বগুড়া মিষ্টি দইয়ের চাহিদা তো থাকেই। রমজান আসলে মিষ্টি দইয়ের কিছুটা চাহিদা কমলেও সাদা দইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই জন্য ক্রেতাদের সাদা দইয়ের চাহিদা বেশী থাকায় আমরা সাদা দই রমজান মাসের শুরু থেকে সাদা দই বেশী তৈরী করছি।

জেলার অন্যতম দই মিষ্টি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এশিয়া সুইটসের কর্ণধার নূরুল বাশার বলেন, বগুড়ার দই জেলা ছাড়িয়ে দেশের যে কোন প্রান্তে সমাদৃত। এখানকার দই শুধু দেশেই সমাদৃত নয়, দেশ ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের অনেক দেশে। কিন্তু বিদেশে দই রপ্তানিতে বড় সমস্যা হলো সংরক্ষণে। এছাড়া অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বগুড়ার দইয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অখ্যাত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে কম দামে মানহীন দই ঢাকায় নিয়ে বেশি মুনাফায় বিক্রি হচ্ছে।

বগুড়া চেম্বারের সহ-সভাপতি মাফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, বগুড়া জেলায় প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকার বেশি দই বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার দই কেনাবেচা হয়। মিষ্টি বিক্রি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার। এ ছাড়া এখানে মাটির সরা হাঁড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন পাল সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ।

বগুড়া চেম্বারের সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, বগুড়ার দই শুধু ঐতিহ্য আর গর্বই নয়। বগুড়া দইয়ের নাম দেশ ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের বড় বড় দেশে। বরং ব্যবসায়িক অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব অনেক। যেমন দইয়ের বিপুল বাজারের কারণে এই অঞ্চলে অনেক দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বগুড়ার দই যে কোন সময় বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।

নতুনসময়/এএম


স্বাদ, জনপ্রিয়তা, সুখ্যাতি, দই, বগুড়া, বিখ্যাত, সরা দই