সন্তানদের সময় দেয়া হলো না তার

সাতক্ষীরায় দুই পুলিশ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর কনডেমড সেলের তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করেছেন ওবেদ আলী। ছয় মাস আগে নির্দোষ হিসেবে তাকে খালাস দেন সর্বোচ্চ আদালত। ক্যানসারে আক্রান্ত ওবেদ আলী তাই খুলনা সদর হাসপাতালের প্রিজন সেলে শুয়ে শুয়ে কারামুক্তির স্বপ্ন দেখছিলেন। ডাক্তারের কাছে বারবার বলতেন স্যার আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন, যেন সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারি। কিন্তু রায়ের কপি না পৌঁছানোয় আটকে থাকে তার কারামুক্তি।
বাবার নির্দোষ হওয়ার রায়ের কপি দ্রুত পেতে ঢাকা শহরে এসে সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রামের ওবেদ আলীর ছেলে শেখ আশিকুর রহমান শাওন প্রায় এক মাস অনেক চেষ্টা-তদবির করেন। ধরনা দিয়েছিলেন মানবাধিকার কমিশনেও। গত বৃহস্পতিবার বাবার খালাসের রায়ের কপি হাতেও পান। তবে তা কোনো কাজে আসেনি। আজ ছিল ওবেদ আলীর কারামুক্তির দিন। হ্যাঁ তার মুক্তি মিলেছে, তবে কফিনে শুয়ে বেরিয়ে এসেছেন ওবেদ আলী।
বাবার লাশ নিয়ে শাওন জানান, ‘আব্বুকে জীবিত অবস্থায় বের করতে পারলাম না। পরিবারের কাছে রাখার সুযোগ হলো না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম রায়ের কপিটা দ্রুত পাওয়ার জন্য। রায়ের কপি পেলাম কিন্তু বাবাকে জীবিত পেলাম না। এখন যেন তার ময়নাতদন্ত না করে সেই ব্যবস্থাটা করে দেন। এমনিতে অনেক কষ্ট পেয়ে মরেছে। লাশটা যেন না কাটে। আমি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্যারকেও বলেছি। ময়নাতদন্ত যেন না করে, আপনারা দয়া করে সেই ব্যবস্থাটা করে দেন।’
২০০৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ রোডের ফটিক বাবুর বাড়ির সামনে দুই পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করা হয়। ওই হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ২০০৬ সালে রায়হানুল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন ও ওবেদ আলীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত তিন আসামিকে নেওয়া হয় কারাগারের কনডেমড সেলে। তার পর কেটে যায় ১২ বছর। এরই মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণ হয়েছে ওবেদ আলী ও জাকির হোসেন নির্দোষ। এই দুই আসামি নির্দোষ হওয়ার সুসংবাদটি পেয়েছিলেন আরও প্রায় ৭ বছর আগেই হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে বিচার বিলম্বে তাদের কারাবাস দীর্ঘায়িত হতে শুরু করে। চলতি বছর ১১ এপ্রিল আপিল বিভাগও হাইকোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখেন। কনডেমড সেলে থাকাকালে চার বছর আগে ক্যানসার ধরা পড়ে ওবেদ আলীর। লড়তে থাকেন মৃত্যুর সঙ্গে। আপিল বিভাগ নির্দোষ হিসেবে ঘোষিত রায়ের কপি অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হাতে পান ওবেদ আলীর ছেলে শাওন।
রোববার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘সকালে পত্রিকা দেখে আমি অফিসে গিয়ে ওবেদ আলীর ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এর পর জেল সুপারদের সঙ্গে কথা বলেছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম রেজিস্ট্রার জেনারেল রায়ের কপি খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেল সুপারের কাছে পাঠিয়েছে। তাকে তাড়াতাড়ি কারামুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য বললাম। এর পর ছেলেটিকে একটি চাকরি দেব বিষয়টি জানাতে আমাদের একজন অফিসারকে ডাকলাম। ছেলেটাকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম ছেলটা বিবিএ পাস করেছে। সবগুলোয় এ গ্রেড। আমি তাকে বললাম, আমরা তোমাকে একটা চাকরি দেব। তোমার বাবাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে বলো, আমার একটা চাকরি হয়েছে। এই কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই আমার একজন অফিসার এসে দুঃখের সংবাদটি শোনালেন, ছেলেটির বাবা মারা গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওবেদ আলীর জীবনে যা ঘটে গেছে, তা আর কারো জীবনে যেন না ঘটে। কারো বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা হয়, মামলার যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার সম্পন্ন করা পর্যন্ত প্রত্যেকটা কাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। এতে অপরাধীরা দ্রুত সাজা পাবে, তেমনি নিরাপরাধীরা দ্রুত মামলার জাল থেকে মুক্তি পাবে। এটা করতে ব্যর্থ হলে মামলা প্রমাণও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। বিচারপ্রার্থীরা সঠিক বিচার পায় না। আবার যারা বিনা অপরাধে কারাগারে আছে, তাদের কারাবাস দীর্ঘায়িত হতে থাকে। এতে তাদের পরিবারের যে কত ক্ষতি হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব কারণে দ্রুততার সঙ্গে বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষকে আর যেন এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়।’
খুলনা মেডিক্যালে মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর পরে নির্দোষ ওবেদ আলী বাড়ি ফিরছেন। মৃত অবস্থায় তার বাড়ি ফেরা মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
ওবেদ আলীর স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন বিলাপ করতে করতে বলেন, মিথ্যা মামলায় আমার স্বামী সারাটা জীবন কারাগারে কাটাল। যারা আমাদের সহায়সম্পদ সব শেষ করে শান্তি পেয়েছে, তারা বেঁচে থাকুক। বাড়িতে ফিরে লোকটার ছেলেমেয়েদের বুকে টেনে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর ওরা করতে দেয়নি।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সুব্রত কুমার মণ্ডল বলেন, চার বছর আগে ওবেদ আলীর ক্লোন ক্যানসার ধরা পড়ে। মুক্ত পরিবেশে সন্তানদের সঙ্গে বাঁচার আকুতি ছিল তার। বারবার বলতেন স্যার আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে আমি সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারি।
আরকেএইচ