ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি


১৯ জুলাই ২০১৯ ০৩:৩৫

জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। বৃহস্প্রতিবার সকালে জামালপুরে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি রেকর্ড ভেঙ্গে বিপদসীমার ১৬৫সে.মি. উপর দিয়ে বইছে। তলিয়ে গেছে জেলার ইসলামপুর,দেওয়ানগঞ্জসহ ৭টি উপজেলার ৬টি পৌরসভা। পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে ৭টি উপজেলা ৫ লক্ষাধিক মানুষ।পানিবন্ধীদের মাঝে শুকনো খাবারসহ বিশুদ্ধ পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ অধিকাংশরাই আশপাশের উঁচু রাস্তা, আশ্রয়ন প্রকল্প,ঘরের চাল,ব্রিজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্যা কবলিত এলাকার ফসলি জমি, রাস্তা ঘাট, রেল লাইন,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চারিদিকে ছুঁটা ছুঁটি করছে।

জেলার সবচেয়ে বেশী বন্যা কবলিত যমুনা তীরবর্তী উপজেলা ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। ইসলামপুর উপজেলার সাপধরী প্রজাপতি আশ্রয়ন প্রকল্পের আশ্রিত দেড় হাজার বন্যা কবলিত মানুষ এক সপ্তাহ ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন জাপন করছে। কেউ খুজঁ নেইনি বলে বানভাসীদের অভিযোগ।

জেলা ত্রাণ ও পূর্ণবাসন কর্মকর্তা নায়েব আলী বৃহস্প্রতিবার সকাল ৮টার সময় জানিয়েছেন,সরকারি হিসাব মতে, বন্যায় জেলার ৬টি পৌরসভাসহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ,সরিষাবাড়ি, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়নের ৯০হাজার ১০০টি পরিবারের ৪ লক্ষ ৪৩হাজার ১৮০ জন খতিগ্রস্থ ও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মাদাগঞ্জ উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বিপদসীমার ওপরে বইছে যমুনা নদীর পানি। এতে উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। এদিকে সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে যমুনা নদীর পানির স্তর। ২০১৭ সালের ১৩৪ সেন্টিমিটার পানির রেকর্ড ভেঙ্গে বর্তমানে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫৯ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বাড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধঁ ভেঙ্গে উপজেলার চরপাকেরদহ, কড়ইচড়া, গুনারিতলা, বালিজুড়ী, জোরখালী, আদারভিটা ও সিধুলী ইউনিয়নের নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে উপজেলার হাজারো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বন্যা দুর্গতরা বিভিন্ন উঁচু সড়ক ও বাধে আশ্রয় নিয়েছে। আঞ্চলিক সড়কগুলোতে পানি উঠায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকায় এখন পর্যন্ত ৩০ মেট্রিক টন চাউল, নগদ ২০ হাজার টাকা, প্যাকেট শুকনো খাবার, গুড়, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবটে, ১ মেট্রিক টন চিড়া, ম্যাচ এবং মোমবাতি বিতরণ করা হয়। এ সময় ইউএনও আমিনুল ইসলাম, এএসপি সামিউল আলম, কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ তানভীর আহম্মেদ, ওসি রফিকুল ইসলাম প্রমূখ। অন্যদিকে বুধবার দুপুরের বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন- বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান বেলাল, পৌর মেয়র মির্জা গোলাম কিবরিয়া কবির ।

সরিষাবাড়ীতে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গে বিপদ সীমার উপরে বইছে যমুনার পানির স্তর। এ উপজেলায় প্রায় ৬৯০ হেক্টর জমির ফসল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, রাস্তা ,ব্রীজ, কালভাট পানির নিচে ডুবে গেছে। এছাড়া সরিষাবাড়ী-কাজিপুর প্রধান সড়কে ব্রাক্ষনজানী এলাকার ব্রীজ ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সরিষাবাড়ীতে বন্যায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত। ১৫টি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জামালপুরের সরিষাবাড়ীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর পানি বেড়ে ভয়াবহ বন্যায় রূপ নিয়েছে । যার কারনে আঞ্চলিক সড়কগুলোতে পানি উঠায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলা ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছে বলে জানা গেছে। সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা, পিংনা, আওনা, ভাটারা ও কামরাবাদ ইউনিয়নে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও জনবসতি এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের মালিপাড়া, গোবিন্দপটল, উত্তর মালিপাড়া, টাকুরিয়া, বিন্নাফৈর, মানিকপটল, দামোদরপুর, এছাড়া পিংনা ইউনিয়নের দক্ষিণ নলসোন্ধা, বালিয়া মেন্দা, ডাকাতিয়া মেন্দা ও পশ্চিম মীর কুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ উপজেলার ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ও অফিস কক্ষে পানি ঢুকে পড়ায় পাঠদান পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার উচ্চ বিদ্যালয়, চর সরিষাবাড়ী বালিকা দাখিল মাদরাসা, চর জামিরা দাখিল মাদরাসা ও মালিপাড়া দাখিল মাদরাসা বন্ধ রাখা হয়েছে।
পিংনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার মোতাহার হোসেন জয় জানান, তাঁর ইউনিয়নে যমুনা নদীর ভাঙনে কয়েকদিন ৫০টি বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। চরাঞ্চলের মানুষ নিরাপদ পানি, পর্যাপ্ত খাবার ও গো-খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে।।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিহাব উদ্দিন আহমদ ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ১০ মে. টন চাল ও ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে এবং ২৮৪ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ আছে। এছাড়া দুই লাখ টাকা, ৫০ মে. টন জিআর চাল, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও এক হাজার পিস শাড়ি-লুঙ্গি বরাদ্দের চাহিদাপত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
মেলান্দ উপজেলার ৬০ হাজার মানুষ পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে।,ইসলামপুর ‍উপজেলা দুই লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে।

যমুনা নদীসহ জেলার ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে। এ উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যা কবলিত দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় উপজেলা পৌরশহর ও ৮টি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রসাশন ভবন, উপজেলা পরিষদ ভবন, দেওয়ানগঞ্জ বাজার, সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক হাটুপানিতে তলিয়ে গেছে। ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জগামী রেল যোগাযোগ, সানন্দবাড়ী-রৌমারী সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যা প্লাবিত হওয়ায় উপজেলার ১৯১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন। ঐহিত্যবাহি খোলাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে।বানভাসি মানুষের মাঝে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। তবে বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান ত্রাণ বিতরণের খবর পাওয়া যায়নি।

বকশীগঞ্জে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে বন্যার বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ জনপদ লন্ডভন্ড হচ্ছে। বন্যায় চার টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। এদিকে সাধুরপাড়া ইউনিয়নে গাজীরপাড়া থেকে আলীরপাড়া রাস্তা কাম বাঁধ ভেঙে নতুন করে পাঁচ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।