নুসরাতের জানাজায় রহস্যজনক আচরণ ছিলো রুহুলের

নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় প্রথম থেকেই অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার পাশাপাশি অভিযোগের তীর ছিলো স্থানীয় মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি (সদ্য বিলুপ্ত) রুহুল আমিনের দিকে।
স্থানীয়দের এসব অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বীরদর্পে নুসরাতের জানাজায় অংশ নেন রুহুল আমিন। সেদিন জানাজায় তাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন স্থানীয়রা। তার আচরণও ছিলো সন্দেহজনক। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে ধরা পড়ে তার রহস্যজনক চাহনিও! এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সমালোচনামুখর থাকতে দেখা যায়।
তখনই হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার ও ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি আলা উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। তিনি সেদিন বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আসামিরা খুব বেশি দূরে নয়, এ জানাজার মাঠেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের আসামিরা যদি ৪০ হাত মাটির নিচেও থাকে, তাদের সেখান থেকে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
এ বক্তব্যের পর রুহুল আমিনের দিকে অভিযোগের তীর আরো ঘনীভূত হতে থাকে। গত শুক্রবার (২০ এপ্রিল) রুহুল আমিনকে গ্রেফতারের পর শনিবার (২১ এপ্রিল) পাঁচদিনের রিমান্ডের পর ফেনীর সচেতন মহল এবং সোনাগাজীর স্থানীয়দের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়। এ ঘটনায় ইন্ধন ছিলো আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের। যেহেতু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার খুঁটির জোরে ছিলেন এ রুহুল আমিন।
শুধু জানাজায় অংশগ্রহণই নয়, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা যখন নুসরাতের বাড়িতে তার পরিবারকে দেখতে যান, সেদিনও ছিলেন রুহুল আমিন। করেন কবর জিয়ারত। নুসরাতের বাড়িতে যান ফেনী জেলা আ'লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ দলের নেতা-কর্মীরা। এসময় সঙ্গে ছিলেন রুহুল আমিনও। পরের দিন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান নুসরাতের বাড়িতে তার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেদিনও ফেনী জেলা প্রশাসনের কর্মকতাদের সঙ্গে দেখা যায় তাকে।
স্থানীয়রা বলছেন, রুহুল আমিন এ ধরনের ‘চাতুর্য’ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু শেষ রক্ষে আর হয়নি। তার দিকে সন্দেহের তীর পাকাপোক্ত হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনেরও (পিবিআই)। এর ফলশ্রুতিতেই গ্রেফতার হন রুহুল আমিন।
শনিবার বিকেলে তাকে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে তুলে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই-এর পরিদর্শক শাহ আলম। আদালত তার পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া এজাহারের আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উঠে আসে রুহুল আমিনের নাম। কিলিং অপারেশনের পর কিলাররা যখন রুহুল আমিনকে ফোন করেন, তখন রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি তোমরা চলে যাও।
নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, গত ২৭ মার্চ তার বোন নুসরাত শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর সিরাজ উদদৌলা তার মাকে গালিগালাজ করেছিলেন। সে সময় মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনও উপস্থিত ছিলেন। তিনি থাকাবস্থায় অধ্যক্ষ এমন আচরণ করছিলেন। তার নির্লিপ্ততায় তখনও আমরা অবাক হয়েছিলাম।
নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলেন, গত ২৭ মার্চের ঘটনার পর মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি বিচারে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে, আমার বোনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না। তাৎক্ষণিকভাবে যদি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে ঘটনা এতো মর্মান্তিক পরিণতিতে যেতো না। এ বক্তব্যেও অভিযোগের তীর রুহুল আমিনের দিকে ছিলো।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে রুহুল আমিনের ঘনিষ্ঠতার কথা সোনাগাজীর সবার মুখে মুখে। সিরাজই রুহুল আমিনকে কমিটিতে নেন। তবে নুসরাতের ঘটনা আলোচিত হতে থাকলে ভোল পাল্টিয়ে সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন রুহুল আমিন। নুসরাতের কবর জিয়ারত করতে যান জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে রুহুল আমিনকে। তার দিকে অভিযোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে লেখাতে আমার উপকার হয়েছে। আগে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না। এখন আমি মিডিয়ার সামনে গুছিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারছি।
এ বক্তব্যে তার দাম্ভিকমা প্রকাশ পেয়েছে বলেও মনে করছে স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সিরাজ উদদৌলার খুঁটির জোর এ রুহুল আমিন। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর খোলস পাল্টে হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুবিধা পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে নিয়েছেন পরিচালনা কমিটিতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে ধরা পড়লেও এর আগে এমন অনেক অভিযোগ ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি। রুহুল আমিনের ভরসায় সিরাজের ঘনিষ্ঠ সহযোগিরা রাফির পরিবারকে হুমকি দিয়ে সফল না হয়ে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এদিকে, রুহুল আমিনের ব্যাপারে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে মিলে চমকপ্রদ তথ্য। যে লোকটি প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেননি তিনি এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় দেশে কিছু করতে না পেরে একসময় পেটের তাগিদে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কোনো রকমে চলতো তার সংসার। আর এখন তিনি কোটিপতি। বিতর্কিত এ আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ জাতীয় পার্টির হাত ধরে। অল্পদিনে তিনি দল পরিবর্তন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ দখল করেন।
একপর্যায়ে সভাপতির অনুপস্থিতিতে বাগিয়ে নেন দলের উপজেলা শীর্ষ পদ। চাঁদাবাজি, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে দলের নেতা-কর্মীরাও তার রোষানলের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে রুহুল আমিন গ্রেফতার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে স্থানীয় লোকজন। উঠে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস।
সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ফয়জুল কবির বলেন, ‘কাগজে-কলমে আমিই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমিতো রিজাইন করিনি। আমাকে বাদ দিয়ে কোনো চিঠিও দেওয়া হয়নি। সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহকে সিনিয়র সহ-সভাপতি করা হয়েছিলো। এরপর তার এবং জেলা কমিটির লোকজনের দাপটে প্রথমে আমি সক্রিয় হতে পারিনি। পরে রুহুল আমিন কিভাবে সভাপতি হয়েছেন তা আমার জানা নেই।’
রুহুল আমিনের ব্যাপারে দলের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান বিকম বলেন, ‘নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা শোকাহত। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এরই মধ্যে সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মুকছুদ আলমকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রুহুল আমিনের ব্যাপারেও অনেকে বলছেন। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে, রুহুল আমিনকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডের খবরে খুশি নুসরাতের পরিবার, স্বজন ও গ্রামবাসীরা। এমন প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতার করায় এ হত্যাকাণ্ডের সুবিচারের আশাবাদীও তারা।
নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, বোনের হত্যার সুবিচার পাবো বলে আমরা এখন আশাবাদী।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, তিনি প্রমাণ করেছেন অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, কোনো ছাড় নেই। অপরাধী যতো শক্তিশালী হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে।
গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যায় নুসরাত জাহান রাফি। মাদ্রাসার এক ছাত্রী সহপাঠী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারধর করেছে, এমন সংবাদ দিলে সে (নুসরাত) ওই ভবনের তৃতীয় তলায় যায়। সেখানে মুখোশপরা চার/পাঁচজন নুসরাতকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল রাতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন অগ্নিদগ্ধ রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত এজহারের আটজনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সাতজন। ১৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড দেওয়া হয়েছে।
নতুনসময় / আইআর