ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ১লা মে ২০২৫, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩২


ঘাঁটিতেই টালমাটাল বিএনপি


১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৫৭

বিএনপি
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলেই টালমাটাল বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নিজ জেলা বগুড়াসহ রাজশাহী বিভাগের আট জেলার সাংগঠনিক অবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর।
 
বগুড়া জেলা বিএনপির কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। একই অবস্থা রাজশাহী বিভাগের নাটোর ও পাবনা জেলা বিএনপিরও। নাটোর জেলার কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে সাত বছর আগে। চার বছর আগে শেষ হয়েছে পাবনা জেলা কমিটির মেয়াদ। 
 
এদিকে দুই বছর ধরে ঝুলে আছে রাজশাহী মহানগর বিএনপির কমিটি। এছাড়া যেসব জায়গায় কমিটি রয়েছে সেখানে রয়েছে চরম অভ্যন্তরীণ কোন্দল। নির্বাচনের ঠিক আগে এসে কোন্দল যেন চরম আকার ধারণ করেছে। 
 
ঘাঁটি বলে পরিচিত এ অঞ্চলে আগামি নির্বাচনে বিএনপি কতটা ভালো করতে পারে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
 
তবে দলীয়ভাবে নাজকু হলেও রাজশাহী বিভাগের নয়টি সাংগঠনিক জেলার বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিপক্ষে। একই সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় আন্দোলন চায় তারা। কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলনে নামলে এ অঞ্চলের বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে মাঠে নামতেও প্রস্তুত তারা। 
 
রাজশাহী জেলা : এক সময় রাজশাহী জেলার ৬টি আসনের মধ্যেই সবগুলোতেই ছিল বিএনপির আধিক্য। কিন্তু বিগত ২০০৯ সালের নির্বাচনে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সব আসন চলে যায় মহাজোটের  দখলে। মূলত এরপর থেকেই রাজশাহী জেলা বিএনপির টালমাটাল অবস্থা। অভ্যন্তরীন দ্বন্দ এতটাই প্রকট কেন্দ্রীয় কোন কর্মসূচিই তারা পালন করতে পারেনা। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সোমবার নগরের অলোকার মোড়ে জেলা বিএনপির মানববন্ধনে উপস্থিতি ছিলেন একশর মত।
 
তবে প্রতিটি আন্দোলন রাজশাহী জেলা বিএনপি সফল বলে মনে করছেন জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন। তিনি বলেন, প্রতিটি আন্দোলনে সফল রাজশাহী জেলা বিএনপি। তবে এখানে সফল আন্দোলন হলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় না। ফলে ঢাকায় সফল আন্দোলন করতে পারলে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ অন্যান্য দাবি মেনে নেবে।কিন্তু ঢাকায় তেমন আন্দোলন না হওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে নেতাকর্মীর মনোবল চাঙ্গা না। 
 
জানা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ৩৪ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠনের পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় রাজশাহী জেলা বিএনপির। কিন্তু এই দেড় বছরেও জেলার ৯ উপজেলা ও ১৪ পৌরসভার অধিকাংশ স্থানেই কমিটি গঠন করতে পারেননি জেলা নেতারা।
 
রাজশাহী মহানগর : রাজশাহী মহানগর বিএনপির অবস্থা খুবই নাজুক। রয়েছে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তার প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা গেছে। মিনু বুলবুল দ্বন্দে এক সময়ের রাজশাহী শহর বিএনপির ঘাঁটি বলা হলেও এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত। 
 
জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ২১ সদস্যের আংশিক কমিটি হয় রাজশাহী মহানগর বিএনপির। কিন্তু এরপর দেড় বছর পার হয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি তারা। অভিযোগ রয়েছে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি তারা। ফলে দলীয় কর্মসূচীতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম হচ্ছে। এমনকি দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচীতেও একশর কম নেতাকর্মীর থাকে। 
 
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। তিনি বলেন, শহরে বিএনপিকে কোনও কর্মকাণ্ড করতে দিচ্ছে না প্রশাসন। কোনও কর্মসূচি পালন করলে পরের দিন নেতাকর্মীদের নামে পুলিশ মামলা দিচ্ছে। তারপরও কমিটি গঠনের কাজ চলছে। দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হবে।
 
রাজশাহী মহানগরের অন্তর্গত ১২ থানার মধ্যে চারটির কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। ওয়ার্ড কমিটির অবস্থা একই।
 
বগুড়া : দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বাড়ি। আর বগুড়া রাজশাহী বিভাগে অন্যতম বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে অনেকে মনে করেন। কিন্তু অবস্থাও নাজুক। ২০১১ সালের এপ্রিলে বগুড়ায় বিএনপির কমিটি হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা কমিটির মেয়াদ দুই বছর। সেই হিসেবে ২০১৩ সালের মার্চে এটির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু এরপর আরও পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন জেলা কমিটি হয়নি। যদিও এই জেলার নেতারা বলছেন, সরকারের নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে নতুন করে সম্মেলনে করে কমিটি করার কোনও পরিবেশ নেই। ফলে নতুন কমিটি দেওয়া যাচ্ছে না।
 
জেলার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন বলেন,২০১১ সালের এপ্রিল মাসে জেলা কমিটি হয়েছে। আমাদের জেলা কমিটি ২০২ সদস্যের। তবে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সরকারের হামলা-মামলার কারণে নতুন সম্মেলন করে কমিটি করা যাচ্ছে না। একই কারণে জেলার আওতাধীন ১২টি উপজেলা, ১২টি পৌরসভার কমিটিরও মেয়াদ নেই। তবে জেলার নেতাকর্মীরা এত হামলা-মামলার পরও আন্দোলন করে যাচ্ছে।তবে তিনি স্বীকার করেন, সাংগঠনিক কিছুটা দুর্বলতা আছে।
 
খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায় না বগুড়া জেলা বিএনপি। জেলা সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যেকোনও মূল্যে আন্দোলন করে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
 
জয়পুরহাট : বছর পার হয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি জয়পুরহাট জেলা বিএনপি। শুধু তা-ই নয়, জেলার আওতাধীন পাঁচটি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভায় বিএনপির কমিটি মেয়াদ শেষ। এই জেলার নেতারা বলছেন, জেলা সভাপতি মোজাহার আলীর মৃত্যু ও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার কারণে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা ও এসব সাংগঠনিক ইউনিটের কমিটি দেওয়া যায়নি।
 
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাফিজুর রহমান পলাশ বলেন, ২০১৭ সালের ৩ মার্চ আমাদের ২৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। পরে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ১৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে পাঠানো হলেও তা অনুমোদন দেয়নি।
 
আন্দোলন ও নির্বাচন প্রশ্নে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না তা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে আন্দোলনের মাধ্যমে দলীয় চেয়ারপারসনকে মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
 
নওগাঁ : ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ৩০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয় নওগাঁ জেলা বিএনপির। তবে এর দেড় বছরের বেশি সময় পারও হয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেননি জেলার নেতারা। জেলার অন্তর্গত ১১টি উপজেলা ও চারটি পৌরসভা কমিটিরও মেয়াদ শেষ।
 
জেলা সভাপতি নাজমুল হক সনি বলেন, আশা করছি এক মাসের মধ্যে জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারবো। আর উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি বিভিন্ন কারণে চাইলেও করা যায় না। এসব কমিটিতে সবাই নিজের পছন্দের লোককে পদ দিতে চায়।
 
নাটোর : ২০০৯ সালে ১৫১ সদস্যের নাটোর জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। এই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে সাত বছর ধরে চলছে জেলা বিএনপি। আর এ কারণে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে স্থবির হয়ে আছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। জেলার আওতাধীন সাতটি উপজেলা ও আট পৌরসভার কমিটিরও মেয়াদ শেষ।
 
জেলা সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল হক বলেন, কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আমাদের মধ্যে কোনও মতানৈক্য নেই। সবাই মিলে কাজ করে যাচ্ছি। কেন্দ্রে থেকে নির্দেশ পেলেই আমরা সম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করবো।
 
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু হলে নাটোরের চারটি আসনে বিএনপি জয়লাভ করবে।’
 
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাটোর জেলা কমিটির এক নেতা বলেন, নয় বছর ধরে একই ব্যক্তিরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাহলে অন্যদের রাজনীতি করে লাভ কী? এ কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা চলে আসছে। ফলে সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি নেই। 
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ অন্যান্য দাবিতে আগামীতে রাজধানী ঢাকাতে আন্দোলন চায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপি। এই জেলার নেতারা বলছেন, জেলায় আন্দোলন করে খুব বেশি ফলাফল আসে না। ফলে আন্দোলনে সফলতা পেতে হলে ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর ঢাকায় আন্দোলন হলে দেশবাসী সবাই দেখতে পাবেন। তখন তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আন্দোলনের প্রতি উৎসাহী হবে।
 
সিরাজগঞ্জ : আগামী দিনে ঢাকার আন্দোলনে কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতাদের রাজপথে দেখতে চায় সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘আগামী দিনের আন্দোলনে ঢাকার নেতাদের রাজপথে থাকতে হবে। তাহলে আন্দোলনে সফলতা আসবে। হরতাল বা অবরোধ যা-ই দেওয়া হোক কেন, স্বল্পমেয়াদের কর্মসূচি দিতে হবে। 
 
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই ৩০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির। একবছরেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি জেলার নেতারা। এ বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু বলেন, বিভিন্ন কারণে আমরা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারিনি। আগামী মাসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
 
সিরাজগঞ্জের ৯ উপজেলা ও সাত পৌরসভা কমিটির অধিকাংশের মেয়াদ শেষ।
 
২০১৭ সালের মে মাসে ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির। তবে জেলা কমিটির একাংশ নিষ্ক্রিয়। তাদের অভিযোগ, সভাপতি নিজের আইন ব্যবসা আর সাধারণ সম্পাদক অধিকাংশ সময় ঢাকায় নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম টিপু। তিনি বলেন, সব ধরনের সভা-সমাবেশে আমি থাকি। এটা মিথ্যা অভিযোগ। জেলার বেশিরভাগ নেতাকর্মীই সক্রিয় থাকে। তবে বিভিন্ন মামলার কারণে হয়তো কিছু নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এ জেলার আওতাধীন পাঁচ উপজেলা ও চার পৌরভার মধ্যে ২-৩টি ছাড়া সব জায়গায় বিএনপির কমিটি রয়েছে বলে জানান তিনি।
 
পাবনা : ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি কেএস মাহমুদকে সভাপতি ও হাবিবুর রহমান তোতাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৭২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়। ২০১৪ সালে এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। একইসঙ্গে জেলার আওতাধীন ৯টি উপজেলা ও ৯টি পৌরসভা কমিটির মেয়াদও শেষ হয়।
 
হাবিবুর রহমান তোতা বলেন, আমাদের কমিটির মেয়াদ শেষ। এই কারণে কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। নতুন কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আর সম্মেলন হয়নি। একই কারণে উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি হয়নি। 
 
এক সময়ের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জেলাগুলো সাংগঠনিক অবস্থা এই। 
 
তৃনমূলের নেতারা বলছেন, সাংগঠনিক দুর্বলতা না কাটলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি এ এলাকার আসনগুলোতে কতটা ভালো করতে পারবে সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
 
একেএ