সংখ্যালঘু ভোটাররা কার পক্ষে যাবে?

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ভোটার শতকরা ১০ ভাগ। নির্বাচনের মাঠে এই ১০ ভাগ ভোটারই জয় পারাজয়ে অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর। সংখ্যালঘু ভোটারদেরকে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক মনে করা হয়। তবে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংখ্যালঘু ভোটাররা আওয়ামী লীগের একক ভোট ব্যাংক নয়। বরং সংখ্যালঘু ভোটাররা নানা বিষয়ে হিসেব নিকেশ, মেরুকরণ এবং পর্যালোচনা করে ভোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, সংখ্যালঘু ভোটাররা সব সময় যে একটা দলের পক্ষে ভোট দিয়েছে বা আনুগত্য প্রকাশ করেছে বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটও বিভক্ত হয়ে পরে এবং কোন দলের প্রতি তাদের সমর্থনও প্রত্যাহার করে। সুতরাং সংখ্যালঘু ভোটার মানেই আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক এই বাস্তবতা মোটেও সত্য নয়। তাই নির্বাচন এলেই প্রশ্ন ওঠে সংখ্যালঘু ভোটাররা কার পক্ষে?
নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটাররা কেন আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে ভোট দিবে তা নির্ভর করে বিগত সময়ের শাসনামলে সংখ্যালঘুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর। সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোট এবারে কার পক্ষে পড়বে তা বিবেচনার ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সংখ্যালঘু নির্যাতন। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলের পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এটা প্রায়শই ঘটে, তবে ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, নিপীড়ন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এরকম ঘটনা গত ১০ বছরে ঘটেনি বললেই চলে।
গত ১০ বছরে সংখ্যালঘুরা যে ভালো অবস্থানে ছিল, তার একটা ইতিবাচক ফলাফল আওয়ামী লীগ পাবে। এজন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা অংশের আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় থাকবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছেন।
নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে হিসেব- নিকেশ এবং বিষয়গুলো বিবেচনা করে তা হলো:
১. ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে দেশব্যাপী যে অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০০১ সালের ঘটনার সঙ্গে গত ১০ বছরের তুলনা করলে দেখা যায়, একদিকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার যেমন অনেক বেড়েছে, তেমনি দেশ ত্যাগের ঘটনা অনেক কমেছে। এসব কারণে সংখ্যালঘুদের ভোট আওয়ামী লীগের পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
২. গত ১০ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও দু-একটি ঘটনার ফলে আওয়ামী লীগের প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে প্রক্রিয়ায় যেভাবে পদত্যাগ করেছেন, তা অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকের অপছন্দ হয়েছে। এ কারণে সংখ্যালঘুদের একটা পক্ষ আওয়ামী লীগের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন এবং তাদের ভোট আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
৩. অতীতে প্রায় সময় অভিযোগ করা হতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশগম্যতা অনেক কম, সরকারি চাকরিতে তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং পদোন্নতিও কম। গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মের বিভাজন রেখা উপরে ফেলেছে। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে প্রচুর সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে এখন সংখ্যালঘুদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ, পদোন্নতি এবং উচ্চ পদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রসর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও অন্যতম একটা দেশে স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং সরকারি চাকরি বা চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করলে সংখ্যালঘুদের এই অংশের ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষেই পড়বে।
৪. ঐতিহ্যগত ভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মনে করেন, তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ এবং বৈষম্য করা হয়, তারা সম্পত্তি, এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকে। অতিতে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন উৎসবে তাদের মন্দির ভাঙচুর, মন্দির দখল, মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে গত ১০ বছরে বাংলা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎসব পালনে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ভয়ভীতিহীনভাবে তারা তাঁদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করেছেন। অন্তত তিনবার এমন ঘটনা দেখা গিয়েছে যে, ঈদ, পূজা এবং বড়দিন একেবারে কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মহররম একদিনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কোনো ধরেনের ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে নাই। নির্বিঘ্নে-নিরাপদে যার যার ধর্ম পালনের স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ সরকার নিশ্চিত করেছে। এ কারণে সংখ্যালঘুদের অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে রয়েছে।
৫. বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বা সংঘবদ্ধভাবেই হোক সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ, ভাঙচুরের কিছু ঘটনা ঘটেছে। যেমন রামুতে বৌদ্ধ বিহারে হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলাসহ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই ঘটনাগুলো সংখ্যালঘুদের মনে রেখাপাত করেছে। এইসব কিছু ঘটনার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু অংশের ভোট আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৬. সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময় আতঙ্কিত থাকে যে, তারা যে দল বা পক্ষকে ভোট দেয়, সেই দল যদি ক্ষমতায় না আসে, তাহলে তাঁদের উপর অত্যাচার এবং নিপীড়ন করা হয় সব থেকে বেশি। সেই কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময় সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেন এবং যে সময় ভোটের জোয়ার যেদিকে সেইদিকেই তাঁরা ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে। সেজন্যেই এখন পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ভোট কোন পক্ষে পরবে বা পূর্ণাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট একটা বাক্সে পড়বে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যেমন জোয়ার ভাঁটার দেশ, ভোটের ক্ষেত্রেও তেমনি জোয়ার ভাঁটা দেখা যায়। সেই জোয়ার ভাঁটায় শেষ পর্যন্ত যেদিকে জোয়ার থাকবে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট হয়তো সেদিকেই পড়বে।
এমএ