গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করলেন ড. কামাল

চলতি বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত ২০ দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এ জোট নিয়ে এরইমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে আলোচনা। জাতীয় ঐক্যের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গণফোরামের সভাপতি ও আইন প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।
স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে গণফোরামের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে কিছু লক্ষ্য, নীতি ও আদর্শ রয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে, গণফোরাম যাদের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন করেছে সেই দলগুলোর নীতি-আদর্শের সঙ্গে গণফোরামের নীতি-আদর্শের তেমন কোন মিল নেই, বরং সাংঘর্ষিক।
গণফোরামের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গণফোরামের ঘোষণাপত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দানকারী নেতাই নন, তিনি এ জাতির জনক হিসবেও দেশে বিদেশে নন্দিত।’ কিন্তু জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক কিংবা জাতির পিতা – কোনোটাই মানে না। এছাড়া নিবন্ধন বাতিল হওয়া দল জামায়াতে ইসলামীও বেনামে এই জোটে সক্রিয় আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী এই দলটি জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে কী মনোভাব পোষণ করে তা সর্বজনবিদিত।
গণফোরামের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘এই আশা আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণভাবে বিবৃত ১৯৭২ সালের সংবিধানে। সাম্প্রদায়িকতার চির অবসান হবে এবং সকল সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূরীভূত হবে।’
অপরদিকে, জোটের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ’৭২ এর সংবিধানের বিরোধী। নিজেকে ’৭২ এর সংবিধানের সমর্থক দাবি করা ড. কামাল হোসেন কীভাবে বিএনপির সঙ্গে জোট করতে পারেন তা রাজনৈতিক মহলের বড় একটি প্রশ্ন।
এছাড়া প্রথম অধ্যায়ের ‘ণ ধারায়’ গণফোরামের লক্ষ্য হিসেবে বিবৃত হয়েছে, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে আন্দোলন সংগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ঐ সংগ্রামকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলে সর্বত্র অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সু-প্রতিষ্ঠিত করা। ধর্মের নামে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা।’
কিন্তু জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই ড. কামাল হোসেন জোট করেছেন যা তাদের ঘোষণাপত্রের বর্ণিত নীতি অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সু-প্রতিষ্ঠিত করা এবং ধর্মের নামে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার একদমই বিপরীত।
‘বিচার বিভাগ ও আইন সংক্রান্ত’ শিরোনামে ঘোষণাপত্রের পঞ্চম অধ্যায়ের ‘জ ধারায়’ বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল ও ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পুনঃস্থাপন করা হবে।’
একই অধ্যায়ের ‘গ ধারায়’ বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আইনতঃ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মারফত তাদের উপযুক্ত শাস্তিও বিধান করা হবে।’
বিএনপিতেও অনেক যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। এছাড়া বেনামে নিবন্ধন বাতিল হওয়া দল জামায়াতে ইসলামীও ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এদের সঙ্গেই জোটবদ্ধ হয়ে ড. কামাল আরেকবার তাঁর দলীয় নীতি ভঙ্গ করেছেন।
আবার ‘নির্বাচন’ অধ্যায়েরই ‘ড ধারায়’ বর্ণিত আছে, ‘দুইটির অধিক আসনে কোনো প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না মর্মে আইন করা হবে।’
কিন্তু ড. কামাল যাদের সঙ্গে জোট করলেন সেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সবসময় ৫টি আসনে নির্বাচন করে থাকেন। এক্ষেত্রে গণফোরামের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল তাদের রাজনৈতিক মিত্রের নীতি।
‘নারী সমাজের উন্নয়ন’ শিরোনামে সপ্তম অধ্যায়ের ‘খ ধারায়’ বলা হয়েছে, ‘সরকারি বেসরকারি সকল চাকুরীতে নারীর জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে শতকরা ৩০ ভাগ আসন সংরক্ষণ এবং তা অবিলম্বে পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।’
অথচ বিসিএসসহ সকল সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি কোটা বাতিলের পক্ষে কথা বলেছেন। শুধু সরকার বিরোধিতার খাতিরে ক্ষমতার লোভে স্বার্থান্ধ হয়ে ’ কোটা প্রসঙ্গে ড. কামাল নিজের দলের ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধেই চলে গেছেন।
ঘোষণাপত্রের নবম অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে, ‘ধর্মকর্ম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’। এই অধ্যায়ের ‘ক ধারায়’ বলা আছে, ‘ধর্ম নিয়ে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রাষ্ট্র বিরত থাকবে।এছাড়া একই অধ্যায়ের ‘খ ধারায়’ বলা হয়েছে, ‘রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বা ধর্মের নামে সন্ত্রাস বে-আইনি বলে বিবেচিত হবে।’
কিন্তু গণফোরাম জোট করেছে একাধিক ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থী দলের সঙ্গে। বিএনপিও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের জন্য পরিচিত। তাই গণফোরাম ঘোষণাপত্রের ‘ক’ ও ‘খ’ ধারার যথাযথ প্রয়োগ যে এই দলগুলোর সঙ্গে থেকে করা সম্ভব না তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে, ড. কামাল জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থী দলের সঙ্গে জোট করে নিজ দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের অনেকগুলো ধারা লঙ্ঘন করেছেন।
এমএ