সিনহাকে নিয়ে কী কী ভুল করেছিল সরকার?

আজ রোববার (২৩ সেপ্টেম্বর) বাজারে আসছে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রচিত আলোচিত বই ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’। সিনহার দেশত্যাগ ও পদত্যাগ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সংবলিত বইটি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এক মহল দাবি করছে, এই দুর্নীতির অভিযোগে সিনহার বিরুদ্ধে বিচার-তদন্ত করার, আবার অন্য মহলে প্রশ্ন উঠছে এতদিন কেন সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। সাবেক বিচারপতি সিনহার বিষয়ে সরকার অনেকগুলো ভুল করেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিভিন্ন মহল।
ক. সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত করাই ছিল সরকারের প্রথম ভুল। প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের আগেই তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। এরপরও কিছু মানুষের প্রভাবে প্রধান বিচারপতি হন সিনহা।
খ. প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর জানা গেল সিনহার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক রয়েছে। সিনহা নিজেও একথা স্বীকার করেছেন। আপিল ডিভিশনের কোর্টে দাঁড়িয়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার ছিলেন। সিনহার ঠিকুজি যাচাই না করেই তাকে প্রধান বিচারপতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া এবং তার স্বাধীনতাবিরোধী অতীত ইতিহাস জানার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া ছিল বড় ভুল।
গ. কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি খেয়াল করেন, সিনহার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা লন্ডনে তাকে টাকা পয়সা দিচ্ছেন। মীর কাসেমের ছেলের কাছ থেকে সাবেক বিচারপতি সিনহার অর্থ নেওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। কিন্তু এমন অভিযোগের পরও সতর্ক হয়নি সরকার। বরং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার শুনানির সময় আপিল ডিভিশন থেকে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে সরিয়ে দেন এস কে সিনহা।
ঘ. বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের যে রায় দিয়েছিল, সেই রায় ফাঁস হয়ে যায়। তখনই সরকারের উচিত ছিল সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়াও উচিত ছিল সরকারের। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি।
ঙ. এই বছরের শুরুতে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যাংক হিসাবে জমা পড়া চার কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া যায়। তখনো সিনহার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
চ. ২০১৭ সালে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দেশের বিচারপতিদের ডেকে ৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছিলেন। এরপর সিনহা দেশত্যাগ করে চলে গেলেন, পদত্যাগপত্র দিলেন কিন্তু সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো তদন্তই করা হলো না। দেশের সাংবিধানিক অভিভাবক ও দেশের প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ করার পর এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে আপিল ডিভিশনের বিচারকগণ সিনহার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসতে অস্বীকৃতি জানানোর পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব ছিল এই অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্ত করা। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো সময়মতো নেয়নি সরকার। দুদক গত এক বছরে কোনো তদন্তই করেনি সিনহার বিরুদ্ধে।
সিনহার বিষয়ে পর পর অনেকগুলো ভুল করেছে সরকার। ঐ সময় সরকারের উচিত ছিল অনেক আগেই সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর তদন্ত করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা এবং এক্ষেত্রে তিনি দেশে না বিদেশে আছেন তা বিবেচনায় না নেওয়া। তাহলে আজকে বই লিখে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি হুমকির মুখে ফেলা সিনহার পক্ষে সম্ভব হতো না। এস কে সিনহার ব্যাপারে সরকারের করা ভুলগুলোর ফলে সিনহার বইটি এখন আন্তর্জাতিক বাজারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি সরকার সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করে তাহলে মনে করা হবে সরকার প্রতিহিংশাবশত তদন্ত করছে। আর এভাবে সিনহার দুর্নীতির বিষয়টি আড়াল হয়ে যাবে। অথচ সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই।
এমএ