বিশ্ববাজারে কমল জ্বালানি তেলের দাম, দেশে কি কমবে

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৭২ দশমিক ৯১ ডলারে অবস্থান করছে। আর ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ৩ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি মূল্য ৬৮ দশমিক ৬৬ ডলার। সোমবার টাইমস অব ইসরাইল এ খবর জানায়।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। বাস্তবতা হলো, মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হিসেবে জ্বালানির উচ্চ দামকেই দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা।
একসময় সরকারের নির্বাহী আদেশে তেলের দাম বাড়ত-কমত। কখন বা কবে তা নির্ধারণ করা হবে, তার ঠিকঠিকানা ছিল না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত দেয়, সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয়প্রক্রিয়া চালু হয়েছে।
গত মার্চ মাস থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। এখন প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। তারপরও বিশ্ববাজারে তেলের দাম হ্রাসের খুব একটা প্রভাব পড়ছে না।
সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট জ্বালানির দাম ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেপ্টেম্বর মাসের জন্য প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। পেট্রল ও অকটেনের দাম কমেছে ৬ টাকা।
বিশ্ববাজারে দাম অনেকটা কমলেও দেশের বাজারে তার অতটা প্রভাব না পড়ার মূল কারণ হিসেবে ডলারের বিনিময় হারকে চিহ্নিত করা যায়। ধরা যাক, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে তেলের গড় দাম ছিল ৮০ ডলার এবং এখনো ৮০ ডলার—খালি চোখে বিষয় দুটি একই রকম মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। এই সময় টাকার অনেকটা দরপতন হয়েছে। তখন ডলারের বিনিময়হার ছিল ৮৬ টাকা, এখন যা ১২০ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ এই আড়াই বছরে দেশে ডলারের বিনিময়হার বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে দাম হ্রাসের প্রভাব দেশের বাজারে অনুভূত হওয়া কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
জানা যায়, দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান হিসাব করা হয়। আগের মাসের জ্বালানি তেলের গড় দামের ভিত্তিতে এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ৩২ শতাংশ শুল্ক–কর; এটিও বড় বিষয়। সেই সঙ্গে আছে পরিবহনভাড়া; ৬ শতাংশ মুনাফা ধরে বিপিসি।
বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য ধরে শুল্ক হিসাব করা হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বা কমলেও এটি পরিবর্তিত হয় না। ট্যারিফ মূল্য সাধারণত কেনা দামের চেয়ে কম ধরা হয়। এতে শুল্ক খরচ কমে বিপিসির।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কেনা দামে শুল্ক নির্ধারণ করতে চায়। সেটা হলে জ্বালানি তেলে বিপিসির খরচ আরো বেড়ে যাবে। যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই ট্যারিফ মূল্য ধরেই দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি।
এছাড়া সরকার মূলত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনে। সরবরাহকারীও নির্দিষ্ট থাকে। যেদিন চুক্তি হয়, তার আগের দিন দিনের গড় দামের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়। তার সঙ্গে তেল পরিবহনের জন্য প্রিমিয়াম যুক্ত হয়। তেলের দাম ওঠানামা করে। ফলে যখন দাম কমে যাচ্ছে, তখন এই চুক্তি করা হচ্ছে কি না, তার ওপর দাম নির্ভর করে।
এছাড়া বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তেল কেনে। এই দুই দেশ থেকে মারাবান ক্রুড ও অ্যারাবিয়ান লাইট কেনা হয়। এই দুটি তেলের দাম ডব্লিউটিআই ও ব্রেন্ট ক্রুডের চেয়ে কিছুটা বেশি।
আরেকটি বিষয় হলো, দেশের তেল পরিশোধনাগারের সক্ষমতা। বাংলাদেশের তেল পরিশোধনের সক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন, যদিও চাহিদা অনেক বেশি। আমদানিই করতে হয় বছরে গড়ে ৬০ লাখ টনের মতো। সক্ষমতা কম হওয়ায় বাংলাদেশকে পরিশোধিত তেল বা ডিজেল কিনতে হয়; এর দাম বিশ্ববাজারে স্বাভাবিকভাবেই অপরিশোধিত তেলের চেয়ে বেশি।
অর্থনৈতিক সুফল পেতে হলে তেলের দাম কমানো দরকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এককভাবে শুধু বিপিসির মাধ্যমে আমদানি না করে অন্যান্য সংস্থাকে দিয়েও আমদানি করানো যায়। এতে বাজারে কিছুটা প্রতিযোগিতা আসবে।
অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ভিন্ন উৎস থেকে তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে ভোক্তাদেরই লাভ। এছাড়া তেলের শুল্ক যৌক্তিকীকরণ করা দরকার।
টাইমস অব ইসরায়েল এক প্রতিবেদনে জানায়, গত শনিবার ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে ইরানের তেল স্থাপনাগুলোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আর এর প্রভাবেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে।
এর আগে, গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ইরান। জবাবে ইরানের তেল অবকাঠামোতে ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে— এমন আশঙ্কায় তখন দ্রুত বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম।