ঢাকা শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩১


যৌনসঙ্গম নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য গান্ধীর


১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২৩:০৬

ফাইল ছবি

শুধু আনন্দের জন্য যৌনমিলন করাকে নারীরা প্রতিরোধ করুক এমনটা চাইতেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সন্তান জন্মদানের জন্য যতটুকু যৌনমিলন দরকার নর-নারীর যৌনসম্পর্ক হবে শুধু ততটুকুই এমনটাই মনে করতেন তিনি।

১৯৩৫ সালে আমেরিকান এক জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল সম্প্রতি তার প্রকাশিত বিবরণ থেকে তার এ ধারনা সম্পর্কে জানা যায়।

এখানেই শেষ নয়, মহাত্বাগান্ধী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা মারা যাওয়ার সময় তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করায় পিতার পাশে থাকতে পারেন নি। বহুদিন এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করেছিল।

সম্প্রতি ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের লেখা গান্ধীর এক নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে উঠে এসেছে নারী অধিকার, যৌনতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা। গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট করেছিলেন।

তিনি লিখেন, নারীর মুক্তি হওয়া উচিত এবং নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া উচিত এবিষয়ে দুজনই একমত মনে হচ্ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব দ্রুতই মতভেদ দেখা দিল।

১৯১৬ সালে স্যাঙ্গার নিউইয়র্কে আমেরিকার প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র খুলেছিলেন । স্যাঙ্গারের মতে, নারীর মুক্তির সবচেয়ে নিরাপদ পথ জন্মনিরোধক। কিন্তু গান্ধী বলেছিলেন, পুরুষদের উচিত তার জান্তব কামনাকে সংযত করা, আর নারীদের নিজ স্বামীদের বাধা দেয়া উচিত। এসময় তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন, সন্তান জন্মদানের জন্য শুধু যৌনক্রিয়া করা উচিত।

স্যাঙ্গার ভারতের ১৮টি শহরে সফর করেছিলেন সে বছর, ডাক্তার ও নার্সদের সাথে কথা বলেছিলেন। জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং নারীমুক্তি ছিল তার কথাবার্তার বিষয়বস্তু। তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্যে গান্ধীর আশ্রমে গেলে তার সঙ্গে স্যাঙ্গারের এই কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা হয়। তবে গান্ধীর মতামত শুনে স্যাঙ্গার দমে না যেয়ে বিতর্ক চালিয়ে গিয়েছিলেন।

এসময় গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে স্যাঙ্গার প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু নারীরও তো গভীর যৌন অনুভুতি আছে, তারা পুরুষের মতোই গভীর এবং তীব্র। এমন সময় আছে যখন নারীরাও ঠিক তাদের স্বামীদের মতোই শারীরিক মিলন চায়। আপনি কি মনে করেন পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ এবং সুখী একজন নারী ও পুরুষ শুধু বছরে দু’একবার যখন সন্তান চাইবে তখনই যৌনমিলন করবে - এটা কি সম্ভব?’।

তার এ প্রশ্নে গান্ধী যুক্তি দিলেন যে, এর মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ খুবই সুবিধাজনক যা নারীকে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার দেহের ওপর নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।

জানা যায়, স্যাঙ্গারের একের পর এক যুক্তির বাণে গান্ধী একগুঁয়েভাবে তার বিরোধিতা করেন। গান্ধী সব যৌনতাকেই ‘কামনা’ বলে মনে করেন বলে তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন।

স্যাঙ্গারকে গান্ধী বলেছিলেন- যখন তিনি ‘শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন ঠিক তখনই তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক ‘আধ্যাত্মিক’ হয়ে উঠেছিল।’

১১১৯ পাতার বইটিতে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত শান্তিবাদী নেতার ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালে তার নিহত হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে।

১৩ বছর বয়েসে গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র। ৩৮ বছর বয়সে গান্ধী চার সন্তানের পিতা হবার পর ‘ব্রহ্মচর্য বা যৌনসম্পর্কবিরহিত জীবনযাপন শুরু করেন।

নতুন বইটিতে জানা গেছে, কথাবার্তার শেষ দিকে মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে গান্ধী কিছুটা একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘‘পুরুষের স্বেচ্ছামূলক বন্ধ্যাকরণে তার আপত্তি নেই, কারণ পুরুষই মুখ্য ভুমিকা নেয়। এছাড়া গর্ভনিরোধক ব্যবহারের চাইতে প্রতিমাসে নারীর যে ‘নিরাপদ সময়’ থাকে তখন স্বামী-স্ত্রী যৌনমিলন করা ভালো বলে মনে করেন গান্ধী।

তবে এসব যুক্তি খুব পছন্দ হয়নি স্যাঙ্গারের। গান্ধী তার ভাবনাকে যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। পরে তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেন, প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অবাধ যৌনাচার সম্পর্কে গান্ধীর প্রচন্ড ভীতি আছে।

একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে গান্ধী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব বলে আপনি কি মনে করেন? বরং নারীদের শেখা উচিত তাদের স্বামীদের কীভাবে ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, শুধু যৌনতার জন্য নারী আর পুরুষ বাঁচবে। তাদের মস্তিষ্ক দুর্বল হবে এবং নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।

‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের বইটিতে রামচন্দ্র গুহ বলছেন, গান্ধী মনে করতেন যৌনতা হচ্ছে ‘জান্তব কামনা’ মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।

বঙ্গ প্রদেশের নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যখন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল তখন গান্ধীকে এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল বলে তিনি লিখেছেন। তিনি তার নাতনি এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে বললেন। তিনি তার যৌন আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা এটা পরীক্ষা করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

গুহ লিখছেন, তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে বলে গান্ধী মনে করতেন। তবে মানু গান্ধীকে নিয়ে ঘুমানোর পরীক্ষার যখন গান্ধী তার সহযোগীদের বললেন, তখন তারা গান্ধীকে এটা না করতে সতর্ক করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এতে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।

এটা দুর্বোধ্য এবং সমর্থনের অযোগ্য বলেও মন্তব্য করেছিলেন গান্ধীর একজন সহকারী। এমনকি এর প্রতিবাদে গান্ধীর আরেক সহকারী তার সঙ্গে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

নারীদের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ছিল জটিল এটা স্পষ্ট। যেসকল নারীরা পুরুষদের সামনে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের দেখতে পারতেন না গান্ধী। আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ছিল তার। মুসলিম নারীদের বোরকারও তিনি বিরোধী ছিলেন।

তবে নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যেরও কট্টোর সমর্থক ছিলেন তিনি। তিনি নারীদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। যখন পশ্চিমা দেশেও নারী রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন অত্যন্ত কম থকন সরোজিনী নাইডুকে কংগ্রেসের নেত্রী বানিয়েছিলেন তিনি।।

তবে সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্ম নারীদেরই কাজ বলে মনে করতেন গান্ধী। তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রীষ্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মতো বলে মন্তব্য করেন তার একজন সহযোগী।

ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।

রামচন্দ্র গুহ তার লেখায় উল্লেখ করেন যে, আজকের মাপকাঠিতে বিচার করলে গান্ধী রক্ষণশীল, তবে তার সময়ের বিচারে তিনি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন।

আইএমটি/এমএ