ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন!


২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৬:২৮

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরঞ্জাম ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অন্যদিকে হাসপাতালটিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিদূর্ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন গুঞ্জন। মেডিকেল ইকুয়েপমেন্টসহ ৬০ কোটি টাকার মালামাল ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে ‘ইচ্ছে করেই’ হাসপাতালে আগুন লাগানো হয়েছে বলে কথা উঠেছে নানান মহলে। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালীন সময়ে এমন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তদন্তে নতুন মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

জানা যায়, গত ৯ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯ ধরণের তথ্য চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের কাজের রেকর্ড চাওয়া হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর দেয়া ওই চিঠির অনুলিপি স্বাস্ব্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও পাঠানো হয়েছিলো। দুর্নীতির বিষয়টি বর্তমানে অনুসন্ধান করছে  দুদকের উপ-পরিচালক সামছুল আলমের নেত্বাতাধীন টিম।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে  শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। প্রায় ৩ ঘন্টা চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৬ টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে। আগুন লাগার পর সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত পুরো হাসপাতালে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে। ওই অবস্থায় হাসপাতালে থাকা প্রায় ১২’শ রোগীকে বের করে নিয়ে আসা হয়। এরপর বেসরকারি এম্বুলেন্সের মাধ্যমে বের করে আনা রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। খবর পেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ প্রসাশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমারকে প্রধান করে সাত সদস্যের আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিলো। মূলত ওই অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য পায় দুদক। বিভিন্ন হাসপাতালে ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির বড় ধরনের তথ্যের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেও কেনা কাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পায় অনুসন্ধানী টিম। এরই অংশ হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২০১৬ -২০১৭ এবং ২০১৭- ২০১৮ অর্থ বছরে যাবতীয় কেনাকাটায় কত টাকা বরাদ্ধ হয়েছে, তার অনূকুলে কি ধরনের মালামাল ক্রয় করা হয়েছে এসব বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া হয়।

চিঠিতে টেন্ডার ডকুমেন্ট, অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা, চাহিদাপত্র ও দরপত্র বিজ্ঞপ্তির মূল কপি, ওয়েবসাইটের কপি, দরপত্রের প্রশাসনিক অনুমোদন, অনুমোদিত প্রেসক্রিপসন, দরপত্র উম্মুক্তকরণ প্রতিবেদন, কারিগরী মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, কার্য সম্পাদনের জামানত,         কার্যাদেশ, সার্ভে রিপোর্ট, কারিগরি বিল, পরিশোধিত কপি এবং বরাদ্ধের নীতিমালাসহ যাবতীয় নথিপত্র গত মাসের ২০ তারিখের মধ্যে সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। চিঠির পর সোহরাওয়ার্দী কর্তৃপক্ষ কিছু নথিপত্র সরবরাহ করছে। তবে আরও কিছু নথিপত্র ছিলো সেগুলো এখনো সরবরাহ করা হয়নি।

সূত্র জানায়, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতালে ইকুয়েপমেন্ট  কেনাকাটায় দরপত্র আহবান থেকে শুরু করে সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ঘটেছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিস্ট হাসপাতালের পরিচালক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় রাঘব- বোয়ালরা জড়িত। দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে কিনা দুদক তা তদন্ত করবে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ২ বছর আগেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ঠিকঠাক করতে দু’দফা তাদেরকে চিঠি দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে তাদের কি কি দূর্বলতা রয়েছে তা উল্লেখ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দু’বছর আগে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারাদেশে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাপনা ঠিক আছে কিনা এমন প্রতিষ্ঠানগুলো সার্ভে করা হয়। ওই সার্ভে প্রতিবেদনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের নামও রয়েছে। এর মধ্যে তাদের দুই বার চিঠি দিয়ে সতর্ক করার পরও তারা অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আগ্রহী হয়নি। ফায়ার সার্ভিস বিভাগ মনে করছে স্টোর রুম থেকে আগুন লাগার বিষয়টি পুরোপুরি রহস্যজনক। এ ধরনের আগুনে নাশকতাও হতে পারে।

এদিকে একজন চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার নামে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি যন্ত্র বাবদ ১৩ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র কেনা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডাঃ উত্তম কুমার বড়–য়া হাসপাতালের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্যই সঠিক নয় দাবি করে বলেন, কেনাকাটার সকল কাগজপত্র তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। কেউ অভিযোগ করতেই পারেন। দুদক থেকে বিভিন্ন সময় তথ্য চেয়ে তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সব চিঠির চাহিদামত কাগজপত্র সংগ্রহ করে দেয়া হয়েছে। তবে দুনীতি দমন কমিশন থেকে গত ৯  জানুয়ারি পাঠানো চিঠি সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। যন্ত্রপাতি কেনাকাটা কেনাকাটায় কোন অনিয়ম হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসলে বিস্তারিত জানা যাবে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ডাঃ ইকবাল আর্সলান মুঠোফোনে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। তাই সবার উচিত অনিয়ম, দুনীতি বন্ধ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহযোগিতা করা। কেউ যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে যদি টাকা নিয়ে থাকে তবে সেই সন্দেহ দূর করতে বরাদ্ধের চিঠি, এজি অফিসের টাকা দেয়ার তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত করলে ক্লু কেরিয়ে আসবে। হাসপাতালে আগুন নিয়ে সন্দেহ হলে তাও তদন্ত করে দেখা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।