চার দিনে ৪৬ জনকে অপহরণ, আতঙ্কে টেকনাফের জেলেরা

মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে টানা ১১ মাসের সংঘাতের পর গত বছরের আগস্টে রাখাইনের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এরপর থেকে নাফ নদ ও সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের প্রায়ই অস্ত্রের মুখে অপহরণ করছে তারা। গত নয় দিনে ৫১ জেলেকে অপহরণ করে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বুধবার (২৭ আগস্ট) সন্ধ্যা পর্যন্ত একজনকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
গত ১৭ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত এসব অপহরণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবশেষ ২৬ আগস্ট টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় স্থানীয় জেলেরা আতঙ্কে রয়েছেন। তারা মাছ ধরতে সাগরে নামতে ভয় পাচ্ছেন। পাশাপাশি অপহরণের শিকার জেলে পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন আছে। অপহৃতদের দ্রুত ফেরত আনার দাবি জানিয়েছে তারা।
স্থানীয় প্রশাসন ও জেলেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৭ আগস্ট পাঁচ, ২৩ আগস্ট ১২, ২৪ আগস্ট ১৪, ২৫ আগস্ট সাত এবং ২৬ আগস্ট ১৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এই হিসাবে টানা গত চার দিনে ৪৬ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। যাদের কাউকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরত আনা যায়নি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে মাছ ধরে ফেরার পথে শাহপরীর দ্বীপের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে টেকনাফের নাইট্যংপাড়ার বাসিন্দা মো. আলম এবং জাদিমুরার হেলাল উদ্দিনের মালিকানাধীন দুটি ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।
ট্রলার মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাটার সময় নাব্যতা সংকটের কারণে ট্রলারগুলোকে মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি দিয়ে চলাচল করতে হয়। গত ৫০ বছর ধরে এভাবে জেলেরা যাতায়াত করে আসছিলেন। হঠাৎ নাফ নদে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। আমাদের জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের জলসীমানায় ঢুকে জেলেদের ধাওয়া দিচ্ছে। গত চার দিনে ৪৬ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। যাদের কাউকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরত আনা যায়নি। আমাদের সরকারের উচিত এর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। না হয় আমাদের লাখো জেলে পরিবারে দুর্দিন আসবে।’
স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, আরাকান আর্মি শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি নাফ নদের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় স্পিডবোটযোগে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করছে জেলেদের। তাদের ধাওয়ায় মঙ্গলবার একটি মাছ ধরা ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। ওই সময় ছয় জেলেকে জীবিত উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এ ছাড়া নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে ঢুকে যখন-তখন জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এটি বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, মিয়ানমারের মংডুর সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। নাফ নদ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ভাগ করে রেখেছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে টানা ১১ মাসের সংঘাতের পর গত বছরের আগস্টে রাখাইনের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এরপর থেকে জেলেদের অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। মাঝেমধ্যে তাদের ফেরত আনছে প্রশাসন।
ট্রলার মালিকরা জানিয়েছেন, নাফ নদের ওপারে মিয়ানমার অংশে আরাকান আর্মি একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেরা বারবার অহরণের শিকার হচ্ছেন। মাঝেমধ্যে অপহৃত জেলেদের ফেরত দিলেও মাছ-জাল লুট করে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। গত কয়েক দিনে তাদের আতঙ্কে ঘাটে ফিরেছেন জেলেরা। এ অবস্থায় জেলে পরিবারগুলো খেয়ে না খেয়ে দিন পারছে। অনেক স্বজন অপহৃত জেলেদের ফেরার অপেক্ষায় আছেন। তাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়নি।
টেকনাফের ট্রলার মালিক তারেকুর রহমান বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুরে ধাওয়া দিয়ে দুটি ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে তারা। এর একটু দূরে থাকা আমার ট্রলারের জেলেরা ভয়ে ঘাটে ফেরেন। এ অবস্থায় প্রায় সব ট্রলার ঘাটে অবস্থান করছে। জেলেরা বিপাকে আছেন। এভাবে চলতে পারে না।’
কায়ুকখালিয়া ট্রলার মালিক সমিতি ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত আট মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদ সংলগ্ন এলাকা থেকে অন্তত ৩০০ জেলেকে অপহরণ করেছিল আরাকান আর্মি। তাদের মধ্যে বিজিবির সহায়তায় ২০০ জনকে কয়েক দফায় ফেরত আনা হয়। বাকি ১০০ জন জেলে এখনও তাদের হেফাজতে রয়েছেন। এর মধ্যে গত চার দিনে ৪৬ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।
গত ২৩ আগস্ট শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা সুলতান আহমেদের মালিকানাধীন ট্রলারটি ঘাটে ফেরার পথে ১২ জেলেসহ ধরে নিয়ে যায়। চার দিন পার হয়ে গেলেও এখনও তাদের ফেরত দেয়নি।
ট্রলার মালিক সুলতান আহমেদ বলেন, ‘আমার ট্রলারসহ জেলেদের এখনও (বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত) ফেরত দেয়নি তারা। ফলে জেলেদের পরিবারগুলো আতঙ্কের মধ্য রয়েছে। দীর্ঘদিন পর মাছ ধরার সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ এখন মাছ শিকারের সময়। কিন্তু আরাকান আর্মির ভয়ে মাছ শিকারে যেতে পারছেন না জেলেরা। সব মিলিয়ে আমাদের দুর্দিন যাচ্ছে।’
কায়ুকখালিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমদ বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাফ নদের মিয়ানমার অংশে মাছ ধরায় একধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে আরাকান আর্মি। তারা বাংলাদেশি জেলেদেরও নদীতে মাছ ধরার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। যখন-তখন অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনে খাদ্য সংকটের কারণে বাংলাদেশি জেলেদের নৌযান ও মালামাল লুট করা হচ্ছে। এ অবস্থায় টেকনাফের জেলেদের সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। আমাদের সমিতির আওতায় প্রায় ২৫০টি মাছ ধরার নৌযানে তিন হাজার জেলে মাছ ধরতে যায়। এখন সবাই আতঙ্কে ঘাটে বসে আছে।’
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথের শাহপরীর দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা সংলগ্ন নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন কায়ুকখালিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম।
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে নাফ নদে আরাকান আর্মি দৌরাত্ম্য বেড়েছে। যার কারণে বারবার জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা খুব আতঙ্কে আছি। যত দ্রুত সম্ভব জেলেদের ফিরিয়ে আনা দরকার। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট বিএন শাকিব মেহবুব বলেন, ‘মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলারডুবির ঘটনায় নাফ নদে ছয় জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা বারবার জেলেদের বলার পরও জলসীমানা অতিক্রম করছে। যার কারণে জেলেরা আরাকান আর্মির হাতে ধরা পড়ছে। যার কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। ইতিমধ্যে আমরা নাফ নদে টহল জোরদার করেছি। পাশাপাশি জলসীমানা অতিক্রম না করতে জেলেদের নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি।’
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘আরাকান আর্মি মাছ লুট করতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে আমাদের বিজিবি-কোস্টগার্ডের টহলের পাশাপাশি জেলেদের সচেতন করা খুব দরকার। যাতে জেলেরা জলসীমানা অতিক্রম না করে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘আরাকান আর্মির হাতে অপহৃত জেলেদের দ্রুত কীভাবে ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে আমাদের বিজিবি, কোস্টগার্ড কাজ করছে। এ ছাড়া নাফ নদে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল এবং নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মূলত নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে ভাটার সময় জেলেদের নাইক্ষ্যংদিয়া হয়ে আসতে গিয়ে মিয়ানমারের জলসীমানা অতিক্রম করতে হয়। এ সুযোগে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। কীভাবে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা যায়, সে উপায় খুঁজছি আমরা।’