দুদককেও করতে হবে জবাবদিহি

কাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে এই জবাবদিহি করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে কীভাবে জবাবদিহি করবে– এসব বিষয় উল্লেখ থাকবে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক যদি মুখ দেখে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে যাতে কারও না কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয়. সেটি খুঁজে বের করছে সংস্কার কমিশন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাতে দুদককে জবাবদিহি করতে হয়, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার দায়িত্ব সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সরকারই দুদক প্রতিষ্ঠা করে এর পরিচালনা ব্যয় বহন করে। এ ক্ষেত্রে দুদক এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকে। এটি থাকার পরও রাজনৈতিক প্রভাব ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দুদককে রুখে দাঁড়াতে হবে। এটি না পারলে অবশ্যই দুদককে সুনির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই দুদক সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন পেশ করবে। এরপর প্রতিবেদনের আলোকে দুদককে ঢেলে সাজানো হবে। সংস্কার কমিশন দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর করতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ, প্রস্তাব ও মতামত দেবে প্রতিবেদনে। দুদককে স্বচ্ছ, গতিশীল ও এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাসহ নানা বিষয়ে সংস্কার কমিশন সুপারিশ করবে বলে জানা গেছে।
সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, দুদকের সর্বোচ্চ পদ কমিশনের চেয়ারম্যান ও দু’জন কমিশনারের নিয়োগ নিয়ে সব সময় রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। দলীয় এবং দলীয় আনুগত্য থাকা ব্যক্তিদের ওই সব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংস্কার কমিশন এমন সুপারিশ করবে, যাতে নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে এবং সংকট সৃষ্টি না হয়।
দুদক আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান ও দু’জন কমিশনার নিয়ে কমিশন। সুপারিশ করা হবে পাঁচ সদস্যের কমিশন করার জন্য। বর্তমানে চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সার্চ কমিটি যেভাবে কাজ করছে, সেটি বাস্তবে কতটুকু নিরপেক্ষ বা সংশ্লিষ্ট পেশার দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাই করে, তাদের ট্র্যাক রিপোর্ট খতিয়ে দেখে মনোনয়ন দেওয়া যায়– সে ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থাকবে বাছাই কমিটিতে কারা থাকবেন, তারা কী প্রক্রিয়ায় কাজ করবেন– এসব বিষয়ে। যোগ্য ব্যক্তিদের যাতে কমিশনে নিয়োগ দেওয়া যায়, সেটি নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখা হবে। কারা আছেন, কারা থাকবেন, এখন যারা আছেন তারাই যথেষ্ট কিনা– বিষয়টি পরীক্ষা করা হচ্ছে। চেয়ারম্যান, কমিশনারদের নাম বাছাইয়ের পদ্ধতিগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।
কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি আছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হচ্ছে। দুদকের কাজে যাদের প্রেষণে আনা হয় বা যাদের সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের মধ্য দ্বন্দ্ব, অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্নীতির যথেষ্ট প্রমাণ সংস্কার কমিশনের হাতে আছে। দুদককে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করা হবে, যেখানে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি থাকবে না।
সংস্কার কমিশনে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না এলে দুদককে যতটুকু ঢেলে সাজানো হোক না কেন, এটিকে আদর্শ ও আন্তর্জাতিক মানের করা হলেও প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারবে না। আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে কিনা– সেটি দেখার বিষয়। দুদক নিয়ে এই চ্যালেঞ্জটা থেকেই যাবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, সুপারিশ অনুযায়ী আদর্শ, কার্যকর দুদক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে, হয়তো প্রতিষ্ঠা হবেও। তারপরও এটা বাস্তবায়ন করা হবে কিনা, প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করবে কিনা, সেটি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সে সময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, আমলাতন্ত্র, তার সঙ্গে ব্যবসায়িক-ত্রিপক্ষীয় আঁতাত হয় তাদের মধ্যে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে দুদককে ঢেলে সাজানো কখনোই সম্ভব হবে না। তার মানে এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরই নির্ভর করতে হবে।’ দুর্নীতি দমনের কাজ সফলভাবে করতে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, কর আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পরিবর্তনের কথাও বলা হচ্ছে। ওই সব আইন যেসব ক্ষেত্রে দুদকের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে, দুদক আইনকে খর্ব করছে এসব ক্ষেত্রে আইনের ধারাগুলো পরিবর্তনের সুপারিশ করা হবে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়েও জোর দেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে, তাদের জবাবদিহি অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। এর পাশাপাশি দুর্নীতি যাতে না হয়, তার জন্য দুর্নীতিবিরোধী অংশীজন, সাধারণ মানুষের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দুদকের আইনগত দায়িত্ব থাকলেও সেগুলো কার্যকর করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কার্যকর নানা পদক্ষেপের কথা বলা হবে প্রতিবেদনে।
কাজের ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন দুদকের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা চায়। একই সঙ্গে দুদকের কার্যকর, উচ্চমাত্রার জবাবদিহিও আবশ্যক। কারণ কোনো স্বাধীনতাই সীমাহীন না। অনেক ক্ষেত্রে সীমাহীন স্বাধীনতা অপব্যবহার করে শুধু যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদের বাদ দিয়ে ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দুদক ব্যবহৃত হবে– এই সংস্কৃতির জন্যই দুদককে জবাবদিহি করতে হবে। কার কাছে, কীভাবে জবাবদিহি করতে হবে কিছু মতামত দেওয়া হবে। তবে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না এলে দুদকের প্রতি বাইরের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।