পাসপোর্টের পরিচালক মামুন যেন অপ্রতিরোধ্য

# বিভাগীয় মামলাসহ কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে আবেদন
# বেনজিরকে জালিয়াতি পাসপোর্ট দেয়ার সহায়তায়ও হচ্ছে তদন্ত
# ঘুষ সিন্ডিকেটের তথ্য ফাঁস, নিজ অফিসের কর্মচারী, ২৩ জন দালাল ও শেরেবাংলানগর থানার এএসআই ঘুষের সঙ্গী
পাসপোর্টের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন যেন অপ্রতিরোধ্য। নিয়ম নীতি, সিনিয়র জুনিয়র এমনকি কার সঙ্গে কি ব্যবহার করতে হবে এসব কিছুই তুচ্ছ যেন তার কাছে। সরকারী এই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এতটাই প্রতাপশালী যে মহাপরিচালকের সামনে তার কোন আদেশ না মানার ঘোষণা দেন, অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। তার ভয়ে শুধু তার অফিস নয়, প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত অতিষ্ট থাকেন। অথচ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে মামলা চলমান। অন্তত ১৫ ধরনের গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে প্রমানিত হয়েছে। দুটি তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে এর মধ্যে একটি হলো আলোচিত পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরীতে তিনিই সব ধরনের সহযোগীতা করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে তাকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদও করে।
এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কিভাবে ঘুষ আদায় করা হয়, কার মাধ্যমে করা হয় তার পুরো সিন্ডিকেটের তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রণালয়েও প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে নিজ অফিসের কর্মচারী, ২৩ জন দালাল এবং শেরেবাংলা নগর থানার এক এসআইয়ের মাধ্যমে ঘুষের টাকা লেনদেন করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
আব্দুল্লাহ আল মামুনের চলমান শৃঙ্খলা বহির্ভুত আচরণ, অসাচারণ, দূর্ণীতির অভিযোগ অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হুমকি বলে মনে করে অধিদপ্তর। তার কর্মকান্ডে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত থাকার ফলে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম দূর্নীতি ও অসাদাচারণসহ আচরণবিধির বিষয়ে জবাবদিহিীতা নিশ্চিত করার জন্য এবং অধিদপ্তরের সুস্থ কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনার স্বার্থে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা সহ কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরী বলেও ওই আবেদনে মতামত দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দুই দফায় সে যেহেতু টানা ৬ বছর একই অফিসে কর্মরত সেহেতু সেখান থেকে জরুরী ভিত্তিতে তাকে ঢাকার বাইরে বদলির বিষয়েও আবেদনে উল্লেখ রেয়ছে।
অতি সম্প্রতি আব্দুল্লাহ আল মামুনের অপরাধ ফিরিস্তি তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার এই আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনে আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে গত ২৭ জাুনয়ারি অধিদপ্তরের ত্রৈমাসিক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সভায় বক্তব্য রাখছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এ সময় তিনি সকল রিতিনীতি ভঙ্গ করে নিজে মাইক নিয়ে উচ্চস্বরে হৈচৈ শুরু করেন। মাল্টিপল অ্যাকটিভ পাসপোর্টে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আবশ্যকতার বিষয়ে মহাপরিচালকের নির্দেশনার সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমরা পরিচালকের কোন আদেশ মানব না। মন্ত্রণালয়ের আদেশ মানবো। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর কর্তৃক কারণ দর্শানোর নোটিশও জারি করে। কিন্তু তার এই বক্তব্য অধিদপ্তর সন্তুষ্ট না হয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। বর্তমানে এ বিষয়ের ওপর তদন্ত চলমান রয়েছে।
বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক জেবুন্নাহারকে অধিদপ্তর হতে টাঙ্গাইলে বদলি করা হলেও তিনি তার ক্ষমতাবলে ছাড়পত্র না দিয়ে আটকে রাখেন। দীর্ঘ ১০ মাস পর মহাপরিচালকের সরাসরি হস্তক্ষেপে পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে অবমুক্ত হয়ে টাঙ্গাইলে যোগদান করেন। এ বিষয়েও তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। অধিদপ্তরের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি উস্কানিমূলক পোষ্ট দেন। একজন সরকারী কর্মচারী হিসেবে ওসই পোষ্টটি শিষ্ঠাচার বহির্ভুত বলে উল্লেখ তাকে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয়া হয়। গত ২৫ জানুয়ারি দুদর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে মহাপরিচালককে অবহিত করার নিয়ম থাকলেও তিনি পুরো বিষয়টি গোপন রাখেন। পরে মিডিয়াতে অভিযানের খবর প্রচার হলে মহাপরিচালক বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন। এ বিষয়েও তাকে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয়া হয়।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গতবছরের ২৫ জুন বৈধ ওয়ার্ক পারমিট কার্ড ব্যতিত একজন এমআরপির গ্রাহককে নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুর রুমে প্রবেশ করেন। এ সময় তিনি তার সঙ্গে অসাচারণ শুরু করেন তারওপর অনিয়মতান্ত্রিক চাপ প্রয়োগ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ওই আবেদনকারীকে শেরেবাংলানগর থানায় গিয়ে মামলা করতে বলেন। আব্দুল্লাহ আল মামুনের এমন আচরণে অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু তার অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন। তার এই অসাদাচারণে গঠত তদন্ত কমিটি তার এই আচরণের সত্যতা পান। এ বিষয়েও তার বিরুদ্ধ ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। এমআরপি পাসপোর্ট আবেদন জমা ও বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। পরে সেগুলোর তদন্ত হলে তিনি দোষী প্রমানিত হন।
পাসপোর্টে নানা অনিয়ম দূর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুদক দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সম্পদের কোন তথ্য দিতে না পারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এছাড়াও মহাপরিচালক না জানিয়ে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেছেন একাধিক সময়। এমনকি বিদেশ সফরেও গিয়েছেন।
এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুল্লাহ আল মামুন একটি সিন্ডিকেট গড়ে পাসপোর্ট করতে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করে থাকেন। তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে পিও মাজহার, অফিস সহকারী নাজমুল, কম্পিউটার অপারেটর রাজন, আনসার সোহেল,, নাজমুল। এছাড়াও সহকারী পরিচালক হালিমা খাতুনও তার সিন্ডিকেটের সদস্য। এছাড়াও অন্তত ২৩ দালালের নাম এবং মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। দালাল সিন্ডিকেটের মূল হোতা জীবন শিকদার তার ভাই মাহবুব শিকদার ও সোহাগ। এছাড়াও শেরেবাংলানগর থানার এএসআই ইউনুস কবির এই দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে গোপন আঁতাত রেখে আব্দুল্লাহ আল মামুন তার মাধ্যমেই ঘুষের সমস্ত টাকা লেনদেন করেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।