মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া
 
                                # ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পাচার হচ্ছে শত শত কোটি টাকা
# দেশের ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। জুয়ার কারণে পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। দেশের টাকা পাচার হচ্ছে। এসব তো আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি – জুনাইদ আহমেদ পলক- ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী
মেগা ক্যসিনো ওয়ার্ল্ড (এমসিডাব্লু) সবচেয়ে বড় অনলাইন জুয়ার সাইট। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে শুরু ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ডিপোজিট করা যায়। অবশ্য একাধিকবার এই অ্যামাউন্টের টাকা ডিপোজিট করা যাবে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে স্ক্যাটার, সব ধরনের জুয়ার অ্যাপ এখানে রয়েছে। আর এই অ্যাপের জুয়া এখন দেশজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন খেলায় বিনিয়োগের ১০ হাজার গুন পর্যন্ত দেয়ায় ফাঁদে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। জুয়ার কারণে পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। দেশের টাকা পাচার হচ্ছে। এসব তো আমরা মেনে নিতে পারি না। এসব বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, জুয়ার সাইট বন্ধে আমরা কাজ করছি।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, দেশে অনলাইন জুয়া বা গ্যাম্বলিং নিয়ন্ত্রণে অন্যতম চ্যালেঞ্জ তথ্যের ঘাটতি এবং কোনো গবেষণা ও সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা। ধারণা করা হচ্ছে, দেশে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি গ্যাম্বলিং টিম রয়েছে।
তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল অপারেটরগুলোকে আইনের আওতায় আনা জরুরি। ই-মানিতে টাকার সোর্স কখনো দেখা হয় না। এ বিষয়ে বেশ কিছু মামলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাত্র ২০ টাকা বিনিয়োগ করে হয়েছিলেন লাখপতি। পরে সেই নেশায় পড়ে একের পর এক বিনিয়োগ করেছেন। তবে, লাভের মুখ আর দেখা হয়নি। উল্টো লোকসান হয়েছে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। অনলাইনে জুয়া খেলার নেশায় পড়ে সব হারানো এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের জীবনের গল্প এটি।
শুধু তিনি নন, জুয়ার নেশায় পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাজধানী ঢাকার ওই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করি। এরপর উচ্চ বেতনে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কাজ শুরু করি। হঠাৎ এক বন্ধুর মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি সামনে আসে। কৌতূহলবশত আমিও পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করি। পরে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে খেলতে নেমে একবারে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পাই।পুরো বিষয়টি আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে আরও টাকা ইনভেস্ট করি। একপর্যায়ে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি। জুয়ার অধিকাংশ খেলা হতো রাতে। ফলে আমি আমার অফিসের কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ি। একটা সময় আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যাই। একইসঙ্গে অর্থকড়িও লস হতে থাকে। চাকরি চলে যায়। সবমিলিয়ে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লস করি।
জানা যায়, ভয়াল এ থাবা থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মসহ সব-বয়সীদের রক্ষা করতে বারবার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে, শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখা যায়নি। বিদেশে থেকে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচালনা করছেন তাদের কার্যক্রম। অন্যদিকে, দেশে থাকা তাদের এজেন্টরা সুকৌশলে করছেন সহযোগিতা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকার মালিক হচ্ছেন তারা (দেশীয় এজেন্ট)। এ টাকার প্রায় শতভাগ লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় অফারের নানা ভিডিও এবং বুস্ট করা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিকাংশ জুয়া বা বেটিং সাইটগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। সেখানে শুরুতে সদস্য টানতে অবলম্বন করা হচ্ছে কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছে মানুষ। একসময় লোভে পড়ে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা। তখনই বেরিয়ে আসে আসল রূপ। মোটা অঙ্কের টাকা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় জুয়ার বোর্ডে। লোভ আর নেশায় বুঁদ হওয়ার পরপরই হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যায় এসব নামসর্বস্ব ওয়েবসাইট। শুরু হয় আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ, এ বিষয়গুলো হচ্ছে বাউন্ডারি লেস ক্রাইম। যার নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি নেই। এক দেশে ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, আরেক দেশে চালানো হয় আর লেনদেন করা হয় আরেক দেশে। এগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধ। সত্যি কথা বলতে, তেমনভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া এসব জুয়াকে কেন্দ্র করে আগে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েতে লেনদেন হতো। এখন দেশীয় বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। এ সংক্রান্ত অ্যাপসের রেজিস্ট্রেশনও খুব সহজ করা হয়েছে। এজন্য অনলাইন জুয়াগুলো একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এটি নিয়ন্ত্রণে টাকা-পয়সার লেনদেন কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অপারেটররাই পারবেন এসব কার্যক্রম বন্ধ করতে। তারা যদি নির্দিষ্ট এজেন্ট কিংবা নির্ধারিত নম্বরের লেনদেন তদারকি করেন তাহলে অস্বাভাবিক ক্যাশ-ইন, ক্যাশ-আউট কিংবা টাকা ট্রানজেকশনের বিষয়টি ধরতে পারেন। তারা সচেষ্ট হলে অনলাইন জুয়া ৫০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. খলিল-উর-রহমান বলেন, আমরা এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছি। একটি ওয়েবসাইট ব্লক করে দেওয়ার পর তার সঙ্গে সামান্য একটি ডট যুক্ত করে নতুন করে সেটি (ওয়েবসাইট) ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা ২৬ হাজার ওয়েবসাইট ব্লক করেছি। প্রতিদিন আমাদের টিম এসব কার্যক্রম বন্ধে নজরদারি রাখছে। তারপরও তারা নানাভাবে অনলাইন জুয়াকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।
সাইবার বিশেষজ্ঞ ও ডিকোডস ল্যাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন, প্রযুক্তির এ যুগে আপনি চাইলেই এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। ব্যক্তিপর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরি ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কারণ, এসব জায়গায় বিনিয়োগ করা খুবই সহজ। শুরুতে অল্প টাকা দিতে হচ্ছে। যেমন- আপনি ২০ থেকে ১০০ টাকা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলা শুরু করতে পারেন। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার এখুনি সময়।

 
                 
                                                    -2019-06-05-12-27-15.jpg) 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                        -2024-09-02-09-55-40.jpg) 
                                                         
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                            