ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২

রুপের ফাঁদ, ধরা দিলেই নিঃস্ব


৯ জুলাই ২০২৪ ১৩:২৫

ছবি সংগৃহীত

#ফেসবুকে ভারতীয় সুন্দরীদের হ্যানি ট্র্যাপ

# তরুনীদের প্রতারণার সহায়তায় কাজ করছে বাংলাদেশি এজেন্ট

রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় বসবাসরত বেসরকারী এক ব্যাংকের কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক) তার ফেসবুকে ফ্রেন্ড হওয়ার রিকুয়েস্ট আসে মুসকান রায় নামের এক তরুনীর। তিনি তার প্রোফাইলে দেখেন মেয়েটি অনেক সুন্দরী। বিভিন্ন লোকেশনের ছবি ও সর্ট ভিডিও আপলোড করা রয়েছে। তিনি রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার ঘন্টা খানেক পরে ম্যাসেঞ্জারে হাই লেখেন মুসকান। এরপর তিনিও রিপ্লে দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুসকান লেখেন তিনি সেক্স পছন্দ করেন কি না ? একই সাথে নানা রসালো আলাপ শুরু করেন। এক পর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়েন। ম্যাসেঞ্জারেই ভিডিও কলে দু’জনেই নগ্ন হয়ে কথাও বলতেন। একদিন হটাৎ করেই ব্যাংক কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপে তার নগ্ন হওয়ার ভিডিও পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকিও আসে। দাবি করা হয় ১০ লাখ টাকা। উপায়াহীন হয়ে ওই কর্মকর্তা ভিডিও প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। পরে প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়ে তিনি রক্ষা পান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমে ফেসবুকে বন্ধুত্ব ও কথোপকথন, তারপর ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা; এরপর ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতার ভিডিও চিত্র সম্পাদনা করে নানাভাবে প্রতারণা এবং দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধারাবাহিকতা চালান একজন সুন্দরী নারী আর এর শিকার হন ধনাঢ্য ও খ্যাতনামা ব্যক্তিরা। ঘটনার প্রকৃতি বলে, এটা অনেকটা অতীতের ‘হানি ট্র্যাপ’-এর মতো। অতীতে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ‘হানি ট্র্যাপ’ বা সুন্দরী নারীদের দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা হতো। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে ভারতীয় সুন্দরী তরুণীরা বাংলাদেশিদের এ ‘মধু ফাঁদে’ ফেলছেন। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা এ ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ তথ্য মতে - গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা তাদের নিকট এসেছে। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩০টির মতো। প্রতিটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। চাতুর্যপূর্ণ এ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উপ-পুলিশ কমিশনার পদে পেদান্নতিপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, গত তিন মাসে সিটিটিসির কাছে কমপক্ষে ২০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা এসেছে। এগুলোর মধ্যে দেশের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষও রয়েছেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে চক্রগুলো বাংলাদেশি নাগরিকদের সহায়তায় এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। তাদের সংখ্যা প্রায় ৫০০।

তিনি বলেন, ফেসবুকে কারও রিকুয়েস্ট আসলে তা দেখে শুনে অ্যাকসেপ্ট করতে হবে। আর নিজেকে সংবরন ও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ওই ব্যাংক কর্মকর্তাই নন এই হ্যানি ট্রাপের শিকার দেশের হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট অভিযোগ দেয়া ভুক্তভোগীর সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ‘হানি ট্র্যাপে’র মতো প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া আরেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তিনিও একইভাবে টাকা খুইয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতারণার ফাঁদটি পেতেছে মূলত ভারতীয় সাইবার অপরাধীদের একটি চক্র। এ চক্রে সে দেশের নারী-পুরুষ ও বাংলাদেশের এজেন্টসহ প্রায় ৫০০ সদস্য রয়েছেন। শুধু ভারতেই রয়েছে ১৫০ জনের মতো সদস্য। বাকিরা বাংলাদেশি, তারা ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিত্তশালী, ব্যবসায়ী, ভিআইপি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে হানি ট্র্যাপে ফেলেন প্রতারকরা। মূলত তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নিতে এ পন্থা অবলম্বন করেন তারা। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্য নয়, মোটা অঙ্কের অর্থ পেতে সরকারি কর্মকর্তা, সেলিব্রিটি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলেন ভারতীয় তরুণীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এ ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পা দিয়েছেন সরকারি কর্তারা। তারা প্রত্যেকেই বিবাহিত। মোটা অঙ্কের অর্থ খোয়ালেও তারা মামলা করতে চান না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম বিভাগে লিখিত অভিযোগ করে জানান। অনেকে আবার ব্যক্তিগতভাবে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে ব্ল্যাকমেইলের তথ্য জানান।
এ বিষয়ে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিষয়টি সুরাহা করতে বলেন। অনেক উঁচু মহল থেকে ফোন করান। রেস্টুরেন্ট বা হোটেল লবির মতো নিরাপদ স্থানে আমাদের বিষয়গুলো জানান। তবে, তারা যেহেতু মামলা করতে চান না সে কারণে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে হয়।

জানা গেছে, মূলত আসাম, মেঘালয় ও শিলিগুড়ি এলাকা থেকে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলছেন ভারতের মেয়েরা। তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ওয়েবসাইট থেকে ভিআইপি ও উচ্চবিত্তদের নম্বর সংগ্রহ করেন। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ফেসবুক থেকে তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। যেসব মেয়ে বাংলাদেশি পুরুষদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে প্রতারণা করেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ দেশের (ভারত) প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আর্মড ফোর্সে কর্মরত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে তারা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে টেক্সট চ্যাটিং করেন। পাশাপাশি ভারতের +৯১ কোড সম্বলিত ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়েও কথা চালিয়ে যান।