শতাধিক সন্ত্রাসীতে জিম্মি কড়াইল বস্তির লাখো মানুষ

রাজধানীর বিষফোঁড়া বলা হয়ে থাকে কড়াইল বস্তিকে। সরকারী জমিতে গড়ে উঠা রাজধানীর অন্যতম বিশাল বস্তিকে ঘিরে এমন কোন অপরাধ নাই যা হয় না। সরকারী জমি হলেও বস্তিতে চলে কেনা বেচা। দীর্ঘদিনেও প্রায় দেড় লাখের বেশি বস্তিবাসী এক শ্রেণীর প্রভাবশালীদের বলয় থেকে বেরুতে পারেনি। ওই সকল প্রভাবশালীরাই শতাধিক সন্ত্রাসীকে দিয়ে বস্তির গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের টাকা উঠানোর পাশাপাশি এখানে মাদক ও জুয়ার ভয়াবহ আস্তানা গড়ে তোলেছে। মূলত এদের কাছেই জিম্মি নিরিহ বস্তিবাসী।
এদিকে প্রতিবছর কমিটি অথবা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি খুন হয়ে থাকে। লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা এ বস্তিতে। এখানে রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় এ চাঁদার টাকা তুলে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়।
গত ১৭ আগষ্ট বস্তিতে আলামিন নামের এক যুবককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আর এ ঘটনায় পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারের বিষয় অবহিত করতে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মহানগর ডিবির প্রধান।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান বলেন, কড়াইল বস্তিতে প্রতিবছর কমিটি অথবা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি খুন হয়ে থাকে। প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় এনেছি। মধ্যস্বত্ত ভোগীরা চাঁদাবাজি করে আসছে। তারা যে টাকা দেয় সেটা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। এসময় গত ১৭ আগস্ট সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল এবং মাসুদ আলম। তাদের কাছ থেকে বড় ছোরা, চাপাতি ও ডিস্ক কুড়াল, লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন আর এর মাধ্যমে বস্তির ঘরভাড়াসহ অবৈধভাবে বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবার টাকা আদায় ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট বস্তির এরশাদ মাঠ এবং নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু-কবির-আলী গংয়ের সাথে রিপন-জুয়েল-শুভ গংয়ের মারামারির ঘটনায় আলামিন নামের একজন নিহত হয়। এছাড়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আরও অনেকে আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আলামিন হত্যার ঘটনায় বনানী থানায় একটি মামলা করে তার পরিবার। এরপর ডিবি গুলশান বিভাগ ছায়া তদন্ত শুরু করে গত ২২ থেকে ২৩ আগস্ট পাঁচজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে।
সংবাদ সম্মেলনে হারুন অর রশীদ বলেন, রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকা বনানীতে সুউচ্চ চাকচিক্যময় বহুতল ভবনের পাশাপাশি এ সব আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকার রিকশা শ্রমিক, পরিছন্নতাকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ নিম্নআয়ের মানুষের আবাসস্থল কড়াইল বস্তি। মূলত টিএন্ডটি, গণপূর্ত ও ওয়াসা ইত্যাদি সরকারি সেবা সংস্থার জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ঘর অথবা দোকান। এসব ঘর-দোকানের অবৈধভাবে নির্মাণ, বরাদ্দ এবং হস্তান্তরে বড় ধরনের আর্থিক চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। এসব স্থাপনায় অবৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়া ডিশ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ময়লা বাণিজ্য প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও টাকা তোলা হয়। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় এ চাঁদার টাকা তোলে এবং ভাগ-বাটোয়ারা করে।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ঘটনার সূত্রপাত ঘোষিত নতুন কমিটি এবং দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব নিয়ে। কড়াইল বস্তি মূলত ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত, যার শতকরা ৯০ ভাগ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মধ্যে। মফিজুর রহমান এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কড়াইল বস্তির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুটি গ্রুপের বিবাদ চলে আসছে। গত ২২ জুলাই ঘোষিত সাতটি ইউনিট অর্থাৎ কড়াইল উত্তর-১, কড়াইল উত্তর-২, কড়াইল বউবাজার-পূর্ব, কড়াইল বউবাজার-পশ্চিম, কড়াইল মশার বাজার, কড়াইল গোডাউন বস্তি এবং কড়াইল স্যাটেলাইট ইউনিট আওয়ামী লীগ- এই সাতটি কমিটির বেশিরভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খানের গ্রুপ প্রাধান্য পাওয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করে। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র একটি ইউনিটের সভাপতি এবং আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছাড়া অন্য কোনো পদ দেয়া হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘নুর আলম ওরফে নুরু কড়াইল উত্তর-২ আর দক্ষিণ ইউনিটের সহ-সভাপতি হওয়ায় এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে এবং মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন ওরফে রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে নিয়মিত মহড়া করতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু-আলী-কবির গ্রুপের মহড়ার এক পর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে। অল্প সময়ের মধ্যে উভয় গ্রুপের লোকজন দল ভারী করে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এশার নামাজ চলাকালে নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাইস্তা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়ার সময় রিপন-জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদেরকে প্রথমে জিআই পাইপ এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে হাত ভাঙাসহ মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কোপায়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নুরুর নেতৃত্বে ভাইগ্না আলী, মোহাম্মদ আলী, কবির, আজিজুল, খাজা , আমজাদ গং আরো হিংস্র হয়েও উঠে একাধিক ঘর এবং দোকানও ভাঙচুর করে। নুরু এবং কবির ছোরা ও চাপাতি নিয়ে আলামিন এবং নাসিরকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করে। নাসির এবং আলামিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদেরকে আক্রমণ করে। গুরুতর আহত আলামিন প্রথমে ভাঙ্গারি দোকান এবং পরে এরশাদ মাঠের একটি ওষুধের দোকানে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে যখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাওয়ালাকে মারধর করে। এ সময় খাজা এবং আমজাদ এসে আলামিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরবর্তীতে রিকশাওয়ালা সামনে একটি রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল পেয়ে তড়িঘড়ি করে আলামিনকে তুলে দিয়ে প্রথমে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে আলামিন মারা যান।
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, ফিরে ফিরে সহিংসতা: কড়াইল বস্তিতে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফিরে ফিরে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে বলে জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা বা সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ রাশেদ কাজী হত্যাকাণ্ড, সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটেছে এ বস্তিকে কেন্দ্র করে।
দীর্ঘদিন ধরেই কাউন্সিলর মফিজ তার প্রধান সহযোগী শাহিন শিকদার, যুবলীগ নেতা মোস্তফাকে দিয়ে বস্তির একক আধিপত্য ধরে রেখেছে। নিহত আলামিনও তারই গ্রুপের সদস্য।
সরকারি সেবা সংস্থার উদাসিনতা ও ব্যর্থতা: বিভিন্ন সময় দেখা যায়, সেবা সংস্থার লোকজন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে ওই চাঁদাবাজদের ছত্রছায়ায় বস্তিবাসীরা হামলা করে। তবে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এ সব অবৈধ বা চোরাই সংযোগের বিষয়ে অজানা কারণে উদাসীন থাকে।
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, বস্তিকে ঘিরে সাঁড়াশি অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় আমরা পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বস্তিকে ঘিরে শতাধিক সন্ত্রাসী রয়েছে। দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে তাদের নিকট। আর এরাই এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছে।