কৌশল পাল্টে মহাসড়কে ডাকাতি

কৌশল পাল্টেছে সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্র। পূর্বে রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলে বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটাতো কিন্তু যাত্রীবেশে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা অহরহ ঘটছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীবেশে ডাকাতরা নির্জনস্থান পেলেই ডাকাতি করতে পারছে। এক্ষেত্রে তাদের বেগ পেতে হচ্ছেনা। পুলিশও বুঝতে পারছেনা যে বাসের মধ্যে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। সংঘবদ্ধ এ ডাকাতদলে এক শ্রেণীর চালকরাও থাকছে। এ কারণে চালকের উপর আক্রমন করে বাসের নিয়ন্ত্রন নিয়ে এরপর ভয়ভীতি হুমকির মধ্যে ফেলে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাসের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলে বাস ডাকাতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ জন্য তারা বাস মালিকদের সঙ্গে কথাও বলবেন। তবে পথিমধ্যে যাত্রী তোলাকে ভয়ঙ্কর বলছেন তারা।
বাসে ডাকাতির ধরন সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলো একটি নিদিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী তুলে আবার নিদিষ্ট স্থানে নামিয়ে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু তারা তা করছে না। তারা মহাসড়কের যেখানে-সেখানে থেকে যাত্রী তোলে। এ কারণে মহাসড়কে বাসে ডাকাতি বেড়ে গেছে।
বাসে যাত্রীদের ভিডিও করা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং প্যানিক বাটক লাগানোর মাধ্যমে ডাকাতি রোধ সম্ভব বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন মালিকরা। তারা চালক-সহকারীদের সতর্ক করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, যাত্রী বেশে উঠে চলন্ত অবস্থায় ডাকাতি হয় বলে টহল পুলিশের পক্ষে তা বোঝার উপায় থাকে না। আগে যেটা দেখা যেত রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ডাকাতি হতো। কিন্তু এখন সেটা হয় না। যাত্রী বেশে বাসে উঠে সুবিধা মতো জায়গায় ডাকাত পরিচয় দিয়ে সব যাত্রীকে জিম্মি ও মালামাল লুট করে নেমে যাচ্ছে। কখনো তারা চালক-সহকারীকে আটকে নিজেরা গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।’ গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বলে জানান তিনি।
মহাড়কে ডাকাতির ঘটনায় পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপের অভাব দেখছেন অনেকে। একই সঙ্গে বাসের চালক-সহযোগীদের নিয়ম না মানা ও আইন ভেঙে রাতে মহাসড়ক থেকে যত্রতত্র যাত্রী তুলে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মহাসড়কে ডাকাতি রোধে পুলিশ সদরদপ্তর বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছিল। তার অধিকাংশই এখনও আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশেরে পক্ষ থেকে ১৮ দফা সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ডাকাতিসহ অপরাধ প্রতিরোধে দেশের মহাসড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ হাইওয়ে বেশকিছু অংশে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এছাড়া মহাসড়কে চলাচলকারী বড় বাসগুলোতে পুশ বাটন বসানোর কাজ চলছে। এতে করে বাসে ডাকাত উঠলে চালক পুশ বাটনে চাপ দিলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে একটি সতর্ক বার্তা যাবে।
মহাসড়কে সাম্প্রতিক ডাকাতি-ধর্ষণ : ১৬ মে ভোর রাতে গাজীপুরের টঙ্গীতে বাসায় ডাকাতি করতে গিয়ে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে ডাকাত দল। ১৮ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সিগঞ্জ এলাকায় রাস্তায় পিকআপ ভ্যান আড়াআড়ি করে রেখে গাড়ির গতি কমানো হয়। এরপর একটি প্রাইভেটকারের দিকে ডাকাতরা পাথর ছুড়তে থাকে। পরে প্রাইভেটকার থামালে সর্বস্ব লুটে নেয় তারা।
গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে কালিয়াকৈর যাওয়ার পথে পাকুল্লা বাজারের কাছাকাছি যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল প্রায় তিন ঘণ্টা হাইওয়ে বাস নিয়ে ঘোরাঘুরি করে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়। বাসের মধ্যে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
ঢাকার আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ১০ সদস্যকে গত ১১ জুন গ্রেপ্তার করে র্যাব। আন্তঃজেলা এ ডাকাত দল যাত্রীবেশে গত দেড় বছরে মহাসড়কে ১৫টির বেশি ডাকাতি করেছে। ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা।
আর ২৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আগ্নেয়াস্ত্রসহ আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ১১ সদস্য এবং একই দিন আরও আট ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে বা বাসে ডাকাতির ঘটনা নিয়ে পুলিশ সদরদপ্তর হাইওয়ে পুলিশ, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একাধিক বৈঠক করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কয়েক দফা বৈঠক করে ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযানসহ ১৮ দফা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে একমত হয়। তবে দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও ডাকাতি বন্ধ ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় সিদ্ধান্তের অধিকাংশ কার্যকর হয়নি।
ডাকাত গ্রেপ্তার করলেও তারা আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে আবার ডাকাতিতে জড়ায় বলে জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একজন ডাকাতকে ঘুরে ফিরে বছরে তিন-চারবার গ্রেপ্তারের নজির আছে। এখন একজনকে যদি এতবার গ্রেপ্তার করতে হয়, তাহলে এই অপরাধ জগতে যারা নতুন করে আসছে, তাদের দমন করব কখন। তাই ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আর কঠোরতা দাবি করেন তিনি।
মহাসড়কে কাউন্টারের বাইরে যাত্রী তোলার পেছনে চালক-সহকারীদের অসততার দায় দেখছেন মালিকরা। এখন মহাসড়কে ডাকাতি যেভাবে বাড়ছে তাতে চালক ও সহকারীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা।
সোহাগ, হানিফ গ্রীন লাইন পরিবহনসহ বেশ কিছু পরিবহন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো পদ্মা সেতু হয়ে গেলে সর্বশেষ সায়েদাবাদ থেকে আর এই গাবতলী হয়ে গেলে নবীনগর থেকে যাত্রী তোলে। এই শেষ কাউন্টার থেকে অনেক সময় যাত্রীদের ছবি তুলে রাখা হয়। কিন্তু দু-একটি সিট খালি থাকলে বাসের সহকারীরা রাস্তা থেকে যাত্রী তোলে। পরে ওই যাত্রীর টাকা নিজেরা ভাগ করে নেন।
সড়কে বাস ডাকাতি প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কের পাশাপাশি রাজধানীতে চলাচল করা বাসে ‘প্যানিক বাটন’ যোগ করা হলে ডাকাতি-ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধ সহজ হবে বলে মনে করে পুলিশ। কিন্তু এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হলেও বাস মালিকরা তা করছেন না।
বাসে একা পেয়ে নারী যাত্রীর শ্লীলতাহানিতে চালক-হেলপাররা যুক্ত থাকে। তখন অবশ্য প্যানিক বাটনের সুফল মিলবে না। যেসব এলাকায় নারী যাত্রী বেশি সেসব এলাকার বাসের ড্রাইভার ও হেলপারের ছবিসহ বৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হবে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, রাজধানী ও মহাসড়কের বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণ রোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কোনো ডাকাতির ঘটনাকে পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
সম্প্রতিক সময়ে মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতি বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহক বলেন, মহাসড়কে ডাকাতি ঠেকাতে হাইওয়ে পুলিশের টহল জোরদার করা উচিত। এছাড়া প্রতিটি বাসে ক্যামেরা থাকা জরুরি। আর বাসের শেষ কাউন্টার থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ও হোটেল থেকে বিরতির পরে যদি ভিডিও করা হয়, তাহলে ডাকাতির ঘটনা কমে আসবে।
‘প্যানিক বাটন’ প্রযুক্তি এখনো চালু হয়নি জানিয়ে এনায়েত উল্লাহ বলেন, নাইট কোচে রাস্তা থেকে কোনো যাত্রী উঠানো যাবে না বলে নির্দেশনা আছে। যদি কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
ডিএমপির এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত বছর ঢাকা মহানগর এলাকায় ২৩টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আর চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে গৃহ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে চারটি ও বাসে ডাকাতি একটি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের আশপাশের মহাসড়কে বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা রাতে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। জেলা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের সমন্বয়হীনতার কারণেও এ ধরনের ডাকাতি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে মালবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা সিলেটসহ অন্যসব অঞ্চলের মহাসড়কেও ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।