ঢাকা সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২

নারীতে শেষ মামুনুল, বিতর্কিত হেফাজত


১৯ এপ্রিল ২০২১ ০৯:১২

ফাইল ছবি

জ্বালাময়ী বক্তব্য আর নানা হুমকি ধমকি দিয়ে মামুনুল হক কওমিপন্থিদের মধ্যে নিজের একটি অবস্থান করে নিয়েছেন তুলনামূলক তরুণ বয়সেই।

বক্তব্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই বাড়ছিল। রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও সরকার ফেলে দেয়ার কথা প্রায়ই বলতেন।

নাশকতার বহু মামলায় আসামি, নিয়মিত উসকানি দেন, হামলায় প্ররোচনা দেন, কিন্তু প্রশাসন তার বিষয়ে ছিল নীরব। গত ২৬ ও ২৮ মার্চে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা দেখে হতভম্ভ হয়ে যায় দেশবাসী। তবে মামলায় হেফাজতের কাউকে আসামি না করা নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা।

তবে যেভাবে চড়েছে সব, পতনও হয়েছে তার চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে।

মামুনুলকে রোববার দুপুর পৌনে একটায় গ্রেপ্তারের পর তার সমর্থকরা তেমন কোনো বিক্ষোভ দেখাননি। একসঙ্গে জড়ো হয়ে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার সামনে খানিক সময়ের জন্য জড়ো হয়ে স্লোগান দিয়ে মোনাজাত পড়ে চলে যায়।

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে এক নারীকে নিয়ে সময় কাটাতে গিয়ে স্থানীয়দের দ্বারা অবরুদ্ধ হন মামুনুল। সেই থেকে তার বেকায়দায় পড়া শুরু।

ওই নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করেন স্থানীয়দের কাছে। বলেন, তার নাম আমিনা তাইয়্যেবা, বাবার নাম জাহিদুল ইসলাম, বাড়ি খুলনায়। পরে জানা যায় সব ভুয়া।


সেই নারী নিজেই জানান তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। বাড়ি ফরিদপুর, বাবা অলিয়র রহমান। পরে তার বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ হয়।

এই জান্নাতকে কেন্দ্র করে মামুনুলের বেকায়দা অবস্থা আরও বাড়ে আরেক জান্নাতে। সেই নারীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস লিপি। তাকেও বিয়ের দাবি করেছেন হেফাজত নেতা। কিন্তু এই গোপন সম্পর্ক ফাঁস হওয়ার পর নিজের স্ত্রী তার চার সন্তানকে নিয়ে মামুনুলের বাসা থেকে সেই যে বের হয়েছেন, আর ফেরেননি।


৩ এপ্রিলের সেই ঘটনার পর ১৫ দিন মামুনুলের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে নিশ্চিতভাবেই।

যার ইশায়ার কওমি মাদ্রাসা ছাত্ররা এখানে সেখানে নেমে তাণ্ডব চালাতে পারত, সেই ছাত্রদের মধ্যেও দৃশ্যত কোনো প্রতিক্রিয়া নাই দেশে বোঝাই যায় রিসোর্টকাণ্ড তাদের মধ্যেও কতটা প্রভাব ফেলেছে।

মামুনুল যেদিন রিসোর্টে অবরুদ্ধ হন, সেদিন তার সমর্থকরা সোনারগাঁ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায় মামুনুলের আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন আরও নয় জন হেফাজত নেতা, যাদের একজন ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীব। এই নেতার একটি বক্তব্যের ভিডিও এখনও ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি সেদিন বলেন, একজন আলেমের গায়ে হাত দিলে তোলপাড় হয়ে যাবে।

মামুনুল যেদিন রিসোর্টে অবরুদ্ধ, সেদিন রাতেই তার পক্ষে হেফাজতকে একজোট হয়ে নামতে দেখা গেছে।

সেই রিসোর্টে ভাঙচুর করে মামুনুলকে ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান ও সুনামগঞ্জের ছাতকেও চলে তাণ্ডব।

কিন্তু এরপর থেকে জান্নাত আরা ঝর্ণাকে দুই বছর আগে বিয়ে করার দাবি নানা ঘটনাতেই প্রশ্নের মুখে পড়তে থাকে আর মামুনুলও নীরব হয়ে যেতে থাকেন।

এক পর্যায়ে মামুনুল লোক চক্ষুর অন্তরালে গিয়ে অবস্থান নেন তার জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায়। গত ১৫ দিন তাকে সেখান থেকে বের হয়ে জনসম্মুখে আর দেখা যায়নি।

এর মধ্যে মামুনুলের সঙ্গে প্রকৃত স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবা, তাইয়্যেবার সঙ্গে মামুনুলের বোনের, মামুনুলের সঙ্গে ঝর্ণার আর হেফাজতের বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, ঝর্ণাকে বিয়ের দাবি বিশ্বাস করছেন না খোদ হেফাজত নেতারা।

মামুনুষের গৃহবিবাদও স্পষ্ট। তাইয়্যেবা সেই ৩ এপ্রিল যে ঘর ছেড়েছেন, তার পর ৯ এপ্রিল ক্ষণিক সময়ের জন্য একবার ফিরেছেন। এরপর আর আসেননি। চার সন্তান নিয়ে তিনি কোথায় আছেন, সেটা বলছে না মামুনুলের ভাইয়েরাও।

রিসোর্টকাণ্ডের পর মুখ খুলতে শুরু করে সরকার

গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবের বেশ কাটতে না কাটতেই ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রাস তৈরি করে হেফাজত কর্মীরা।

সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরের পাশাপাশি দেয়া হয় আগুন। হামলা হয় জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকে।

এসব ঘটনায় মামলা হলেও তাতে হেফাজতের কারও নাম না থাকা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে ৩ এপ্রিলের রিসোর্টকাণ্ডের পরদিন সংসদে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।


প্রথমে সতর্কতা দেন ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বলেন, হেফাজতের কার্যক্রম অনেক সহ্য করেছেন, আর নয়। প্রধানমন্ত্রীকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।


৪ এপ্রিল হেফাজত ইস্যুতে সংসদে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এরপরেই শুরু হয় গ্রেপ্তার অভিযান একই দিন সংসদে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। হেফাজতের তাণ্ডব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেন তারা হাঠাৎ এমন তাণ্ডব শুরু করল। এটা রহস্যময় ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত। এর পেছনে কারণ আছে। উদ্দেশ্য আছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এক হয়ে এটা করছে। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন প্রধানম্নত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বলেন, ‘এদের নাম হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু এরা ধর্মের নামে অধর্ম করে। এরা ধর্ম ব্যবসায়ী। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জামায়াত-বিএনপি। কিছু হলেই তারা সরকারি অফিস, আমাদের বাড়িতে আগুন দেয়। আগুনে কি একজনের বাড়ি পোড়ে? কাল যদি আপনাদের বাড়ি, মাদ্রাসায় আগুন লাগে, আপনারা কী করবেন? মানুষ কি তা বসে বসে দেখবে?

‘আর আইন তার আপন গতিতে চলবে, সেটুকুও আমি বলতে চাই। কারণ একজন মুসলমান হিসেবে আরেকজন মুসলমানের জান, মাল রক্ষা করা হলো দায়িত্ব। আর হেফাজতের নামে তারা জ্বালাও পোড়াও করে যাচ্ছে।’

রিসোর্টকাণ্ডের রাতে মামুনুল চার ভাইকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, সেই নারী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী। পারিবারিকভাবে তারা বিয়ে করেছেন।

দুই দিন পর মামুনুলের জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায় হেফাজত নেতারা জরুরি বৈঠকের পর দাবি করেন, মামুনুল তার দ্বিতীয় বিয়ের যে কথা বলেছেন, সেটি ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী বৈধ।

৮ মার্চ আবার ফেসবুক লাইভে আসেন মামুনুল। তিনি সেদিন ৩২ মিনিটের বক্তব্য দিয়ে পরে তা ডিলিট করে দেন।

মামুনুলের ও স্বজনদের নামে মধ্যকার যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে সেগুলো কার্যত সত্য বলে স্বীকার করে নিয়ে বলেন, এসব ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।


মামুনুল সেদিন এমনও দাবি করেন, ইসলামি শরিয়তের স্ত্রীর কাছে সীমিত ক্ষেত্রে সত্যকে গোপন করারও অবকাশ রয়েছে।

ঝর্ণা বিতর্কের মধ্যে মামুনুলের আরও একটি সম্পর্কের কথা ফাঁস হয় গণমাধ্যমে। এরপর সেই মেয়ের ভাইকে ডেকে নিয়ে মামুনুল দাবি করেন, তিনি জান্নাতুল ফেরদৌস লিপি নামে সেই মেয়েকেও বিয়ে করেছেন।

রিসোর্টকাণ্ডের পর মামুনুল হক আর কখনও জনসম্মুখে আসেননি। দুইবার ফেসবুক লাইভে এলেও একটি লাইভ ডিলিট করে দিয়েছেন । এরপর সেই ভাই মো. শাহজাহান মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করে বলেন, গত ৭ এপ্রিল থেকে তার বোনের খোঁজ পাচ্ছেন না। পুলিশ যেন উদ্ধার করে দেয়।

এরপরের ৯ দিনে মামুনুল তার ফেসবুক পেজে আরবি ভাষায় দুটি সংক্ষিপ্ত স্ট্যাটাস দেন।

তবে ১৬ এপ্রিল রাতে হেফাজতের মহাসচিবের একটি বিবৃতি নিজের পেজে আপলোড করেন। আর ১৭ এপ্রিল নিজের একটি লেখা পোস্ট করেন। এতে তিনি কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক কথা না বলে বন্দিত্বের গুণগান করেন।

তিনি তার সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে লেখেন, ‘নিজ দেশে যারা পরবাসীর মতো থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদের কথা ভিন্ন। অন্যথায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ইমানদারগণ এটা নীরবে মেনে নিতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে জুলুমের মুক্ত বাতাস থেকে প্রতিবাদের বন্দিত্বই হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ!’

এর পর দিনই বন্দিত্বের স্বাদ নিতে হয় মামুনুলকে, যার শুরু হয়েছিল রিসোর্টের জান্নাত আরা ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে।

গ্রেপ্তার অভিযান

১১ এপ্রিল ধরা পড়েন হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। পরদিন তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

১২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে মামুনুল হকের তারবিয়াতুল উম্মাহ মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি ইলিয়াস হামিদী। পরদিন তাকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়।

১৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহ। তিনি গ্রেপ্তার হন ২৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জে সহিংসতার মামলায়।

একই দিন ধরা পড়েন হেফাজতের সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ। তাকে ২০১৩ সালের ৫ মের তাণ্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

১৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন হেফাজতের সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী। হেফাজতের সাম্প্রতিক তাণ্ডবে তার ইন্ধনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

গত ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া গ্রেপ্তার অভিযানে এখন পর্যন্ত হেফাজতের ১০ জন শীর্ষ নেতা ধরা পড়েছেন একই দিন রাতে গ্রেপ্তার করা হয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীকে। তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে তাণ্ডবের মামলায়।

১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন হেফাজতের ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের। তিনি ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনাপ্রবাহের পর মতিঝিল থানায় করা নাশকতার মামলার আসামি।

১৭ এপ্রিল দুপুরের আগে গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতের সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদকে।

একই দিন রাতে গ্রেপ্তার হন হেফাজতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির জুনায়েদ আল হাবিব