সিন্ডিকেটের কবলে সওজ

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া বলয়মুক্তের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। সিন্ডিকেটের কবল থেকে বের হতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ঘুরেফিরে চার প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে সওজের সব কাজ।
জানতে চাইলে সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাব্বির হাসান খান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি ঠিকই; কিন্তু বর্তমানে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে কাজ করছে সরকার।
জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগে নিবন্ধিত আরো শতাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো সওজের সব কাজের যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নানা অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সওজকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, সচিব, সওজের সচিব, প্রধান প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছে কাজবঞ্চিত এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অভিযোগের পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কাজবঞ্চিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, সওজের কাজগুলো ঘুরেফিরে চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- রানা বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেড, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মহিউদ্দীন বাসি প্রাইভেট লিমিটেড, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড। গত এক বছরে এই চার প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার ৯৩ কোটি টাকার ১২ শতাধিক কাজ পেয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রানা বিল্ডার্স ৫ হাজার ৭২ কোটি টাকার ২১০টিরও বেশি কাজ পেয়েছে। মোজাহার এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ৩ হাজার ২১ কোটি টাকার ৬০৮টির বেশি কাজ। এছাড়া মহিউদ্দীন বাসি ৩ হাজার কোটি টাকার ৩০০টি ও হাসান টেকনো ৩ হাজার ১৯ কোটি টাকার ৯০টির বেশি কাজ পেয়েছে। বাংলাদেশ কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের অভিযোগ, একটি সিন্ডিকেট আছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কাজ পায় না। তারাই এটি নিয়ন্ত্রণ করে। এই সিন্ডিকেট কাজ পেলে ডিপার্টমেন্ট কাজের বিষয়টি টাইম টু টাইম আপডেট করে না। টেন্ডার ক্যাপাসিটি নামের একটা অপশন আছে, যা আপডেট না করার কারণে কে কে কাজ পেয়েছে, সেটা ডাটাবেজে পাওয়া যায় না। যার ফলে কে কখন কাজ পাচ্ছে সেটি বোঝা যায় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন বলেন, সড়ক ও জনপথের ঠিকাদারি কাজগুলোর ৯৫ শতাংশই ঘুরেফিরে এই চার প্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে। বাকিরা ৫ শতকরা ভাগ। অথচ একসঙ্গে তাদের এত কাজ করার সামর্থ্য নেই।
সংগঠনের সহসভাপতি এস আমানুল্লাহ বলেন, দেশে অনেক বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু এ সিন্ডিকেটের কারণে কেউ কাজ পাচ্ছে না। ঘুরেফিরে তারাই বারবার কাজ পাচ্ছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের মুখপাত্র ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাব্বির হাসান খান বলেন, দরপত্রের শর্ত ও নানা কারসাজিতে এমন সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙা প্রায় অসম্ভব। তবে এ বিষয়ে কাজ চলছে। তবে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে ইতোমধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের ফলে গত ১ মার্চ উদ্বোধনের আগেই নির্মাণাধীন সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর সড়কের কোন্দানালা খালের ওপর প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সেতু ধসে পড়ে। সেতুটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএম বিল্ডার্স।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএম বিল্ডার্সের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ বলেন, গার্ডার বসানোর সময় হাইড্রোলিক জ্যাক বিকল হয়ে যাওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর সড়কে ৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি সেতু নির্মাণ শুরু করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এই কাজগুলোও পেয়েছে এএম বিল্ডার্স। এর একটি নির্মাণের আগেই ধসে পড়ে। সুনামগঞ্জের বাইরেও আরো কিছু কাজ চলমান রয়েছে এএম বিল্ডার্সের। অথচ একসঙ্গে এত কাজ করার সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির নেই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে এএম বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী সায়েম কাদের সিন্ডিকেটের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ছোট প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্সিয়াল ও ইকুইপমেন্ট ক্ষমতা কম। এ কারণে তারা কাজ পাচ্ছে না। আমাদের সক্ষমতা আছে বলে আমরা কাজ পাচ্ছি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে অভিযান চালিয়ে জিকে বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী জিকে শামীমকে গ্রেফতার করে র্যাব। সওজে তালিকাভুক্ত শতাধিক ঠিকাদার থাকার পরও নানা প্রভাব খাটিয়ে প্রায় সব কাজই তার প্রতিষ্ঠান বাগিয়ে নিত। গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার কাজে ছিল তার একক নিয়ন্ত্রণে। হাজার কোটি টাকার কাজ করছিল তার প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্স। গ্রেফতারের পর তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার কারণে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজই স্থবির হয়ে পড়ে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) অনুযায়ী, টানা ২৮ দিন কাজ বন্ধ থাকার পর আইন অনুযায়ী কাজগুলো বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। সেই নিয়মেই এসব কাজ বাতিল হয়েছে।
ক্রয়চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় গেল নভেম্বরে জিকে বিল্ডার্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। সে অনুযায়ী, র্যাবের প্রধান কার্যালয়ে ভবন নির্মাণ, আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বর্ধিত ভবন, সচিবালয়ে কেবিনেট ভবনসহ জিকে বিল্ডার্সের সঙ্গে দশটি প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এর পরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। সেই নির্দেশনায় সরকারি প্রকল্পের কাজের মান ঠিক রাখা ও সব শ্রেণির প্রতিষ্ঠান যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পায় সেটি নিশ্চিত করতে বলা হয়। পাশাপাশি যারা কাজের মান ও সময় ঠিক রাখতে পারছেন না তাদের চলমান কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা আর কাজ পাবেন না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এমন নির্দেশনার পরও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।