ভয়ঙ্কর প্রতারণায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে প্রতারকরা

বর্তমানে শহর ও গ্রাম সবখানেই নানাভাবে প্রতারণা চলছে। এর মধ্যে চাকরিপ্রত্যাশীরা সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত চক্রের পকেটে ঢুকেছে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা।
মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই একই সময়ে সারা দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুই হাজার ৪৭৭টি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন সাতটি মামলা হয়েছে। র্যাব পুলিশ ও সিআইডির তথ্য মতে, গত এক বছরে প্রতারকচক্রের অন্তত এক হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাকরির নামে বা অন্যভাবে প্রতারণার শিকার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, প্রতারণার ঘটনায় পুলিশ মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়। ফলে কার্যত কোনো তদন্তই হয় না। সে কারণে প্রতারণার ঘটনা বাস্তবে আরো বেশি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীগুলো চেষ্টা করছে এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে এক বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন কৃষক পরিবারের যুবকটি। সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করেন।
এর মধ্যেই তিনি জানতে পারেন যে সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার সুনাপুর এসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম) নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজমুস সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চাকরির আশ্বাস দিয়ে ওই শিক্ষক তার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। বাবার জমি বিক্রি করে চার লাখ আর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে আরো ছয় লাখ টাকা ধার করে গত নভেম্বরে তিনি নাজমুস সালেহীনকে দেন। কিন্তু চাকরি হয়নি তার।
গত জানুয়ারিতে যখন বুঝতে পারলেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন, তখন মামলা করেন। কিন্তু নাজমুস সালেহীনের কাছ থেকে টাকা ফেরৎ পাননি এখনো।
প্রতারণার শিকার যুবক শামীমুজ্জামান এভাবেই বলছিলেন ফাঁদে পড়ার কথা। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার নিশ্চিতবাড়িয়া এলাকার শামীম একই উপজেলার বাসিন্দা নাজমুস সালেহীনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে চাকরির খবর পান এবং তার ফাঁদে পড়েন। খোকসা থানায় তার করা মামলাটি এখন তদন্ত পর্যায়ে আছে।
আরো কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী তাদের প্রতারিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে। এর মধ্যে সম্প্রতি মা ও শিশু কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে চাকরির আবেদন করা বীথি আক্তার একজন।
তিনি বলছিলেন, তিনি ও তার কয়েকজন বান্ধবী চলতি বছরের জানুয়ারিতে শ্যামলীর ঠিকানা ব্যবহার করে একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। আবেদন করার পর ওই প্রতিষ্ঠান নানা ছুতায় টাকা চাইতে শুরু করে। তিনি একপর্যায়ে সাত হাজার টাকা দেন। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানটির অফিস বন্ধ। এরপর যাকে টাকা দিয়েছিলেন তাকে ফোন করে মোবাইল ফোন বন্ধ পান। তার অন্য বন্ধুরাও টাকা দিয়েছিলেন বলেও তিনি জানান।
অতি সম্প্রতি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্মাণাধীন টার্মিনাল-৩-এ দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক ও সুপারভাইজর পদে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে একটি চক্র অন্তত ১৫০ জনের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টার্মিনাল-৩ নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার এ ধরনের নিয়োগের কোনো বিজ্ঞপ্তিই গণমাধ্যমে দেননি। তাহলে কীভাবে এমন নিয়োগের কথা জানতে পারলেন চাকরিপ্রার্থীরা?
প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেওয়ালে বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। ভুয়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকপদে চাকরি দিতে ৫০ হাজার এবং সুপারভাইজার পদের জন্য এক লাখ টাকা ‘ঘুষ’ দাবি করে। টাকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতারণার শিকার হন তারা।
এ ঘটনায় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
যোগাযোগ করা হলে আরমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, তাকে সুপারভাইজার পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দর্পণ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের লোকজন ৮০ হাজার টাকা নেয়। পরে তিনি জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া। টাকাগুলো তিনি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে দিয়েছিলেন।
সুজন নামের আরেকজন বলছিলেন, ভাটারা এলাকায় দর্পণ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের অফিসে যোগাযোগ করার পর তার মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। তিনিসহ মোট তিনজনের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পর তাদের হাতে নিয়োগপত্র ধরিয়ে দিয়ে আড়াই লাখ টাকা নেওয়া হয়।
এছাড়া করোনা পরীক্ষার কথা বলে আরো পাঁচ হাজার করে টাকা নেয় তারা। পরে বিমানবন্দরে গিয়ে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানতে পারেন তারা।
জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘বর্তমানে প্রতারকচক্রের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সিআইডিতে এমন অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে।’
চাকরি দেওয়ার কথা বলে এমন প্রতারণার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, গত বছরের মার্চের শুরুতে দেশে করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব এবং এরপর সরকারি সাধারণ ছুটির কারণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিপ্রার্থীরা পড়ে যান অনিশ্চয়তায়।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের মার্চের তুলনায় গত বছরের মার্চে চাকরির বিজ্ঞাপন ৩৫ শতাংশ কম ছিল। আর এপ্রিলে ছিল আগের বছরের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কম।
তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন দেখা যায় পোশাকখাত, উৎপাদনমুখী শিল্প, স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের।
সম্প্রতি আবার নিয়োগ শুরু হলেও তার হার স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। ফলে যেখানেই চাকরির বিজ্ঞাপন দেখছেন বা খোঁজ পাচ্ছেন, সেখানেই ছুটছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা।
চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর কাফরুল এলাকা থেকে আটজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন একই অভিযোগে ওই এলাকা ছাড়াও শাহ আলী, পল্লবী ও তেজগাঁও এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে একই বাহিনী। ১৮ জানুয়ারি আশুলিয়া থেকে আরো ১১ জন এবং ১ ফেব্রুয়ারি ১২ জনকে আটক করে র্যাব।
করোনাকালে শুধু চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা নয়, করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামেও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে।
এমএলএম ব্যবসা খুলে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করেন সাহেদ। এছাড়া চাকরির নামে অর্থ নেওয়া, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কো-অপারেটিভ থেকে অর্থ আত্মসাৎ, ব্ল্যাকমেইলসহ নানা অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা থাকার কথা জানায় র্যাব। সাহেদকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ১৫ জুলাই।
এরপর জানা যায়, প্রতারণার অভিযোগে একসময় সাজাও হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম নেওয়া সাহেদের। কিন্তু ‘প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যের’ জোরে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতেও পদ পেয়ে গিয়েছিলেন, যদিও তখন আওয়ামী লীগের নেতারা সেটা অস্বীকার করেন।
কয়েক দিন আগে একটি মন্ত্রণালয়ের ভুয়া প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে বড় ধরনের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আশরাফুল ইসলাম দিপু নামের একজনকে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিচালক, উপ-পরিচালক কিংবা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন ২০ বছরের এই তরুণ। বেসরকারি একটি কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও পরিচয় দিতেন তিনি।
ফেসবুকে বিভিন্ন পরীক্ষার ফল পরিবর্তন ও নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে পোস্ট দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের সচিবের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এমন প্রতারণার অভিযোগে গত মঙ্গলবার সৈকত হোসেন ভূঁইয়া ওরফে তপু নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জানতে চাইলে র্যাব-৪-এর সহকারী পরিচালক পুলিশ সুপার (এএসপি) জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন, বর্তমানে প্রতারণা অনেক বেড়েছে।