বাস ভাড়া নিয়ে ডাকাতির রেড জোন !
-2021-02-19-20-22-08.jpg)
বাস ভাড়া করে যাত্রী সেজে ডাকাতি করছে একটি চক্র। অনেক সময় এই ডাকাতদল খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে। চক্রটি রাত ৮/৯ টার পর বাস ভাড়া করে নিয়ে যাত্রী সেজে অন্যযাত্রী বাসে উঠিয়ে সর্বস্ব লুট করে নেয়। অনেক সময় কোন যাত্রী বাধা দিতে গেলে তাকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেনা।
সম্প্রতি একটি হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ংকর এমন তথ্য জানায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিকশন (পিবিআই)। মানিকগঞ্জের চর বাঁচা মরা থেকে ভয়ঙ্কর এ ডাকাত চক্রের কয়েকজন সদস্যকে আটকও করা হয়।
পিবিআই বলছে, রাজধানীর গেটওয়ে টঙ্গি, সাভার, যাত্রাবাড়ি ও ডেমরা এলাকাতে ভয়ঙ্কর এ চক্রটি কাজ করছে। বিশেষ করে ডাকাতির জন্য এ এলাকাকে রেড জোনের আওতায় নিয়ে কাজ করছে গোয়েন্দারা।
পিবিআইয়ের উপ-পুলিশ পরিদর্শক সালেহ ইমরান বলেন, গত ৫ই অক্টোবর হোটেল ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম লস্কর ভাগিনার সাথে দেখা করার জন্য কর্মস্থল মিরপুর থেকে সাভারের জামগড়ার যান। ভাগিনার সাথে দেখা করে স্থানীয় ইসলামিয়া হোটেল মালিকের সাথে দেখা করার কথা বলে বিকেলে জামগড়া ত্যাগ করেন। ওইদিন সন্ধ্যা ৭ টার সময় তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে মেয়ের সাথে শেষ কথা বলেন তিনি। পরে রাত ১২টার দিকে একই মোবাইল থেকে তার মায়ের ফোন নম্বরে ফোন করে রবিউল খুন হয়েছে বলে জানায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। পরে সাভারের বলিয়ারপুরের যমুনা ন্যাচারাল পার্কের গেটের পাশ থেকে রবিউল ইসলাম লস্করের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এঘটনায় নিহতের স্ত্রী হাফিজা বেগম অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে সাভার মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৬। পরে মামলাটির তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে নিজেই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হই।
এঘটনায় তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গত ১৩ই অক্টোবর সাভার থেকে ডাকাত দলনেতা বসির মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয় । পরে তার দেওয়া তথ্যমতে সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই ও ডেমরা থেকে আরও ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সকলেই বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছেন।
তিনি আরো জানান, গত ৪ অক্টোবর গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের নিরালা পরিবহনের একটি বাস কুয়াকাটা যাওয়ার কথা বলে ৩ দিনের জন্য রিজার্ভ নেয়। পরে ওই বাস দিয়ে মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়িতে ডাকাতির কাজ শেষ করে ফেরার সময় নিহত রবিউল আশুলিয়ার নবীনগর থেকে ওই বাসে উঠে। বাসের ভেতরে ডাকাতির সময় রবিউল চিৎকার করলে তাকে ডাকাত সদস্যরা চেপে ধরে ও দলনেতা হুইলরেঞ্জ দিয়ে আঘাত করে। এসময় ঘটনাস্থলেই রবিউল মারা যায়। পরে তাকে বাস থেকে ফেলে দেয় তারা।
সালেহ ইমরান জানান, এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ড্রাইভার ও হেলপার। তারা সাভার, ধামরাই ও যাত্রাবাড়িতে থেকে আন্তঃজেলা ডাকাত দল প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন ধরে বাসে ডাকাতি করে আসছিল। বিভিন্ন রুটের গাড়ি ভাড়া নিয়ে স্টিকার পরিবর্তন করে রং দিয়ে বিভিন্ন রুটের নাম লিখে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ডাকাতি করে আসছিলো চক্রটি।
সূত্র মতে, গত বছরের অক্টোবর মাসে সাভারের হেমায়েতপুরে একটি বাস ডাকাতির ঘটনায় মামলা দায়ের করেন মাইদুল ইসলাম। সেখানে উল্লেখ করা হয় গত ২৪ জুলাই রাত অনুমান ২টায় গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য সাভার থানাধীন হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি অফিস স্টাফ লেখা বাসে ওঠেন মামলার বাদী মাইদুল ইসলাম। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাসচালকসহ অজ্ঞাতনামা সাত-আটজন লোক বাদীর হাত, পা, চোখ বেঁধে বাসের মাঝে শুইয়ে এলোপাতাড়ি মারধর এবং ভয়ভীতি দেখাইয়া তার কাছ থেকে মোবাইল সেট, কাপড়চোপড়, নগদ টাকা এবং বিকাশে থাকা টাকাসহ প্রায় ২৬ হাজার টাকা নিয়ে বাদীকে হাত-পা বেঁধে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় সাভার থানার তুরাগ নদীর পাড় সংলগ্ন রিকু ফিলিং স্টেশনের বিপরীত পাশে ফেলে রেখে বাস নিয়ে চলে যায়।
এদিকে এ ঘটনাও তদন্ত শুরু করে পিবিআই। তদন্ত করতে গিয়েই বাস ভাড়া করে ডাকাতির ভয়ঙ্কও তথ্য পেতে থাকে। পরবর্তীতে মানিকগঞ্জের চর বাঁচামারা থেকে ৫ ডাকাতকে গ্রেফতার করে। দৌলতপুর থানার মো. সুমন মিয়া (২৫), মো. শরীফ মোল্লা (২০), মো. মুহিত শেখ (২২), মো. আলমগীর হোসেন (২৮), মো. রাজীব হোসেন (২১)।
পিবিআই জানায়, গত কোরবানির ঈদের কিছুদিন আগে এই গ্রুপটি গার্মেন্টসের স্টাফ বাস নিয়ে ডাকাতিতে নামে। মূলত গার্মেন্টস ছুটির পর শ্রমিকদের পৌঁছে দিয়ে মধ্যরাতে তারা এই কাজটি করে। বাসটি চালাতেন লালন সরদার। এর আগে লালনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধামরাই থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বাস এবং সহযোগী আলমগীর নামের এক ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পিবিআই জানায়, ওই ঘটনায় মোট ১১ জন ডাকাত যাত্রীবেশী গাড়িতে ছিল। লালনকে গ্রেপ্তারের পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়। অবশেষে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানার দুর্গম চর বাঁচামারা এলাকা থেকে উক্ত চক্রের মূল হোতা আলমগীরসহ পাঁচ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে মুহিত। সে হেলপার হিসেবে গাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে গেট লাগিয়ে দিয়ে ভেতরের লাইট বন্ধ করে দিত। মারধর এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা মোবাইল হাতিয়ে নিত আলমগীর। যাত্রীদের মারধর করে হাত পা চোখ বেধে সাভার এলাকার রাস্তার পাশে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় ফেলে দিত তারা।
এসআই সালেহ ইমরান বলেন, খুবই ভয়ঙ্কর এ চক্র। যাত্রী সেজে বাসের নিরিহ যাত্রীদের অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে এরা সর্বস্ব লুটে নিত। কেউ চিৎকার কিংবা বাধা দিতে গেলে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনা।
তিনি বলেন, এ চক্রটির অনেক সদস্যই গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজধানী প্রবেশদ্বারগুলোতে এ চক্র সক্রিয়। সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গি হেমায়েতপুর, যাত্রাবাড়ি, ডেমরা এ এলাকাগুলোই মূলত টার্গেট করে এ ধরনের ঘটনা করে থাকে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও চোর, ছিনতাইকারী, মলমপার্টিও বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। গত কয়েকদিনের অভিযানে প্রায় অর্ধশতাধিক চোর, ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা রমনা বিভাগের রমনা জোনাল টিম মুগদা এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাতদের আশ্রয়দাতাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে।
অপর এক অভিযানে গোয়েন্দা রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনাল টিম হাজারীবাগ এলাকা হতে অজ্ঞান পার্টির ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করে| একই দিনের আরেক অভিযানে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ টিম তেজগাঁও এলাকা হতে সংঘবদ্ধ মোবাইল চোরাকারবারি দলের সক্রিয় ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোঃ মাহবুব আলম বলেন, আমাদের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ইতিমধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইকারীসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আর এ তালিকা ধরেই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম এ অভিযান পরিচালনা করছে।