র্যাবের জালে ধরা ৭৫ মামলার আসামি কালা মনির

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে অস্ত্র ও বার্মিজ ইয়াবাসহ আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান ওরফে মনিরকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-২।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার ১/২ পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটির বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মনিরের বিরুদ্ধে দখল, অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে প্রায় ৭০টি মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন র্যাব-২ এর কর্মকর্তা মো. মামুন।
তিনি বলেন, ‘মনিরের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ও বেড়িবাঁধ সংলগ্ন ঢাকা উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আশেপাশে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। তার লাইসেন্স করা অস্ত্র থাকলেও সেটি দিয়েই অপকর্ম করতো।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে সত্যতা পেয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মনিরের সঙ্গে আর কারা জড়িত রয়েছে সেসব বিষয়ে র্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
র্যাব সূত্র, ভুক্তভোগী ও মোহাম্মদপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে লাগেজ ভর্তি ডলার নিয়ে সপরিবারে রাতারাতি আমেরিকায় পালিয়ে যান মনির। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গত কোরবানির ঈদের পর দেশে ফিরেই তিনি ঢাকা উদ্যান, নবীনগর হাউজিং ও চন্দ্রিমা উদ্দ্যানে দখল বাণিজ্য শুরু করেন। গত তিন মাসে জাল কাগজপত্র বানিয়ে শুধু ঢাকা উদ্দ্যানেরই চারটি প্লট দখল করেছেন মনির। মনিরের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর থানা ও আদালতে চাঁদাবাজি, জবরদখল, মাদক, অস্ত্র, নারী নির্যাতন, চুরিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে।
জানা গেছে, কালা মনির বাংলাদেশ বিমানের জুনিয়ার পার্সার কাজী আশরাফ আল কাদের ও তার স্ত্রী ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষিকা খাদিজা আক্তারের প্লট দখল করে নেন। আরেক ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা নাজিম, ঢাকা উদ্যানের সি-ব্লকে ১ নম্বর সড়কের একটি প্লটে চলতি বছরে বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে মনির তার কাছে চাঁদা দাবি করে। মনিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলা ও লুটপাটের শিকার হন মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডের আজহার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বরকত উল্লাহ। প্রায় দেড় দশক আগে মোহাম্মদপুর এলাকার এক বিএনপির নেতার মাধ্যমে দখলবাণিজ্যে মনিরের হাতেখড়ি। স্থানীয় কয়েক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতাকে হাত করে চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য চালাতেন তিনি।
র্যাব সূত্র আরও জানায়, ইয়াবা কারবারেও জড়িত কালা মনির। এক সময়ে মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত এসআই আতিক মনিরের হয়ে কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান ঢাকায় নিয়ে আসতেন। মাস দুয়েক আগে আতিক চালানসহ গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। আতিকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে আরেক সদস্য মনিরের ঘনিষ্ট সহযোগী হুমায়নকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও এতদিন গডফাদার মনিরকে পুলিশ রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তার করেনি। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার র্যাবের জালে ধরা পরে কালা মনির।
জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকাবাসীর কাছে মূর্তমান আতঙ্ক ছিলেন কালা মনির। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাছে জিম্মি এখানকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা। বিভিন্ন মানুষের জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও বিআইডব্লিউটিএ’র জমি দখলের অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানা ও আদালতে আদাবর থানার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কালা মনিরের বিরুদ্ধে ৭৫টি মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একটি মামলায় কালা মনির গ্রেপ্তার হলেও জামিন নিয়ে এখন স্বদর্পে তিনি ফিরেছেন ভয়ঙ্কর রূপে। ক্যাডার বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ছেন সাধারণ মানুষের ওপর। তার চাঁদাবাজি ও দখলবাজীতে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। থামানো যায়নি কালা মনিরকে।
কে এম মোস্তফা নাজিম নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ক্রয়সূত্রে ঢাকা উদ্যানের সি-ব্লকের ১ নম্বর সড়কের ২ নম্বর প্লটে বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করলে কালা মনির সম্প্রতি তার কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে গত ২০ আগস্ট দিনগত রাতে নাজিমের প্লটটি দখল ও নির্মাণ সামগ্রী লুট করে মনির ও তার ক্যাডার বাহিনী। প্রতিকার চেয়ে গত ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, আইজিপি ও ঢাকা-১৩ আসনের এমপির দপ্তরে তিনি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেন মোস্তফা নাজিম।
কালা মনিরের বিরুদ্ধে গত ৫ অক্টোবর আইজিপির দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডের আজহার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. বরকত উল্লাহ। অভিযোগে উল্লেখ করেন, ঢাকা উদ্যান এলাকায় সাধারণ মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত কালা মনির। বরকত উল্লাহ ছাড়াও স্থানীয় ইট, বালু ও পাথর ব্যবসায়ীদের কাছে মাসিক চাঁদা দাবী করেন মনির। চাঁদা দিতে না চাইলে বরকত উল্লাহকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, তুরাগ নদের জমি দখল করে অন্তত ২০ থেকে ৩০টি প্লট বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করেন কালা মনির। ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, একতা হাউজিং, রাজধানী হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, গ্রিন সিটিসহ ১০টি হাউজিং প্রতিষ্ঠানের একাধিক প্লট দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব এলাকায় কেউ নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করতে হলে কালা মনিরকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিতে না চাইলে মনিরের ক্যাডার বাহিনী নির্মাণসামগ্রী লুট করে। এ ধরনের অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় মনিরের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে; জিডির সংখ্যা শতকের কাছাকাছি।