রিফাত হত্যা: ষড়যন্ত্রে মিন্নি, নয়ন বন্ড ও ৩ পুলিশ

বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আগে তাকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর জন্য নয়ন বন্ড ফাঁদ তৈরি করেছিল এবং তাতে পুলিশের অংশগ্রহণ ছিল বলে দাবি করেছেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মিন্নি, নয়ন ও তিনজন পুলিশ অফিসার ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলেকে ধরিয়ে দিয়েছিল।
সম্প্রতি পাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রিফাতকে বাঁধার জন্য পুলিশ দড়ি খুঁজছে। এ সময় পাশ থেকে একজন গরুর দড়ি খোঁজার কথা বলে। রিফাত ও মিন্নির পরিবারের অভিযোগ, নয়ন ষড়যন্ত্র করে রিফাতকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তবে পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ বছরের ২৬ এপ্রিল মিন্নির সঙ্গে বিয়ের ১৫ দিন পর ১১ মে রিফাতকে বরগুনার ৯ নম্বর ইউনিয়নের লাকুরতলা এলাকার একটি সড়ক থেকে গাঁজাসহ আটক করে বলে দাবি করে পুলিশ। এ ঘটনায় বরগুনা থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা হয়। এতে ১৭ দিন কারাগারে ছিলেন রিফাত।
এ প্রসঙ্গে রিফাতের বাবা বলেন, এটি অন্য একটি ষড়যন্ত্র ছিল। ষড়যন্ত্রে মিন্নি, নয়ন ও তিন পুলিশ অফিসার জড়িত ছিল। নয়ন তথ্য দিয়ে রিফাতকে ধরিয়ে দেয়।
তিনি বরগুনা থানার তিন পুলিশ অফিসারের নাম উল্লেখ করে বলেন, এসআই (উপ-পরিদর্শক) আসাদুজ্জামান ও কাজী ওবায়দুর রহমান এবং সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. সোহেল খান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আসাদুজ্জামান বর্তমানে পিরোজপুর জেলা পুলিশে কর্মরত আছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি বদলি হন। তবে এস আই কাজী ওবায়দুর রহমান ও এএসআই মো. সোহেল খান বর্তমানে বরগুনা সদর থানাতেই কর্মরত রয়েছেন।
দুলাল শরীফ বলেন, নয়ন বন্ড ও মিন্নি চলতি বছরের ১১ মে আমার ছেলেকে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে জেল হাজতে পাঠায়। রিফাত এই ১৭ দিন জেলে থাকার সময় নয়নের সঙ্গে মিন্নির যোগাযোগ ছিল।
এ বিষয়ে এএসআই সোহেল খান বলেন, সেদিন রাত ১১টার দিকে রিফাত মোটরসাইকেলে আসছিল। আমাদের সিনিয়র অফিসাররা তাকে থামানোর ইঙ্গিত দিলেও সে থামছিল না। এরপর আমি তাকে থামাই। তার পেছনে যে ছেলেটি ছিল, সেই ছেলেটি তার পকেট থেকে এক পোটলা গাঁজা মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর রিফাতের পকেট হাতড়ে আরও এক পোটলা গাঁজা পাওয়া যায়। সেখানে ৫০ থেকে ১০০ জন মানুষ ছিল। এতো মানুষের সামনে আমরা কীভাবে ষড়যন্ত্র করলাম? ওই রাতেই রিফাতের বাবা থানায় এসে আমাদের অনেক অনুরোধ করেছেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, আমরা যদি কোনও ষড়যন্ত্র করতাম, তাহলে তো আমাদের থানা ঘেরাও দিতে পারতো। তা তখন দিলো না কেন?
রিফাতকে গ্রেপ্তারের সময় যে ভিডিওটি করা হয়েছিল, সেটি নয়ন বন্ড করেছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ। তিনি বলেন, ভিডিওতে যার কথা শোনা যাচ্ছে সে নয়ন। এটা নয়নের কণ্ঠই। সে ভিডিও করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে। এটা পুলিশও জানতো।
তবে এএসআই সোহেল খান বলেন, সেখানে অনেক মানুষ ছিল, ভিডিও কে করছে, আমি জানি না। আমরা এখন ভিডিওর কথা শুনছি, আগে কখনও ভিডিওর কথা শুনিনি।
রাতের ভিডিওতে দেখা যায়, এএসআই সোহেল রিফাতের প্যান্ট কোমরের দিকে ধরে বলছেন, তোর বাপের মুখটা যখন দেখলি, তখন গাড়িটা থামাইলি না কেন? এরপর কিছু খারাপ ভাষায় বকা দেয় এএসআই সোহেল। এরমধ্যে কয়েকবার রিফাত শরীফের পায়ে লাথি দেয় পুলিশ। এ সময় রিফাত এএসআই সোহেলকে উদ্দেশ করে বলে, ‘পা-ডা ভাঙা।’ পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, পা ভাঙা হেতে কী হইছে, আবার ভাঙবে। এরপর পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘থানায় নিয়ে আবার ভাঙমু।’
এরপর এএসআই সোহেল রিফাতকে বাঁধার জন্য রশি চান। পাশের একজনকে জিজ্ঞাসা করেন– মোটা রশি আছে কিনা? এ সময় উৎসুক একজন (কণ্ঠ শোনা যায়, দেখা যায় না) বলে ওঠেন, একটা গরুর রশি লইয়ান দেহি।
এ সময় আরেক ব্যক্তি বলে ওঠেন, পাপে ছাড়ে না বাপেরেও। তুই আসটোদিন আমারে ডিবি পাডাইছো, আজ তুই ধরা খাইছো। এ সময় রিফাত শরীফ তাকে বলে, তোরডে জিগাই নাই।
এসআই ওবায়দুর এ বিষয়ে বলেন, সেদিন আমরা অন্য একটি অভিযানে গিয়েছিলাম। ১৫৬ পিস ইয়াবাসহ তিনজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করি। আমাদের সঙ্গে মোটরসাইকেল ছিল দুটি। কিন্তু আসামিসহ লোক বেশি হওয়ায় আমরা একটা মোটরসাইকেলের জন্য লাকুরতলায় অপেক্ষা করছিলাম। এ সময় একটা মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে আসে। মোটরসাইকেলটিকে থামানোর নির্দেশ দেওয়ার পরও সামনে যায়। তখন এএসআই সোহেল মোটরসাইকেলটিকে আটক করে। এ সময় রিফাত মোটরসাইকেলের পেছনে ছিল, সাগর নামে একজন চালাচ্ছিল। তাদের তল্লাশি করে দুই পোটলা গাঁজা পাওয়া যায়। এরপর বিষয়টি ওসি স্যারকে জানাই। ওসি স্যার গাড়ি পাঠানোর পর তাকে থানায় নিয়ে আসি। এ সময় সেখানে ৫০/৮০ জন স্থানীয়রা ছিল। নয়ন ছিল কিনা জানি না, থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। তবে আমি দেখিনি। পরে আমি একটা ভিডিও দেখেছি। তবে ভিডিওটা নয়ন করেছে কিনা আমি জানি না।
রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা সবাই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তবে মামলার এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে এখনও চারজন গ্রেপ্তার হয়নি।