ঢাকা সোমবার, ২২শে ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ই পৌষ ১৪৩২


মতামত


২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:৪২

সংগৃহীত

চ্যানেল ২৪ এর সংবাদে জানতে পারলাম যে হাদির ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পিতার কবরের পাশে শায়িত হতে চান। কিন্তু পরবর্তীতে জানানো হলো, হাদি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে শায়িত হবেন, এবং সেটাই হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগলো, হাদি কি কখনো কাজী নজরুলকে তার আধ্যাত্মিক বা আদর্শিক পিতা হিসেবে ভাবতেন? যদি না, তাহলে কোন যুক্তিতে তাকে জাতীয় কবির কবরের পাশে শায়িত করা হলো? 

 

প্রশ্নটি আমাদের সামনে এক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করছে। হাদি, যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক আদর্শ কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একদিকে কাজী নজরুল ইসলামের সেক্যুলারিজম, সাম্যবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, অন্যদিকে হাদি তার রাজনৈতিক আদর্শে সেক্যুলারিজমের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিপরীত নয়, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিকভাবেও একে অপরের বিরোধী।

 

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কাজ ছিল ধর্মীয় এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতাগুলো ভেঙে ফেলতে, দেশের মানুষের মধ্যে সাম্য এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর কবিতায় তিনি “ধর্মনিরপেক্ষতা” এবং “সামাজিক ঐক্য” প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন, কিন্তু হাদি একদম উল্টো, একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। হাদির রাজনৈতিক আদর্শ এবং নজরুলের আদর্শের মধ্যে যে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে, সেটা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক ক্ষেত্রেও।

 

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত প্রগতি ও মানবিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত। তিনি তার সাহিত্য ও জীবন দিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং ধর্মীয় বিভাজনগুলোর বিরুদ্ধে এক বিরাট সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। নজরুল তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় জুড়ে সাম্যবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। তিনি লেখনী দিয়ে রাষ্ট্রীয় শোষণ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছিলেন, যেমন তাঁর বিখ্যাত কবিতা "বিদ্রোহী" তে এবং অন্যান্য কবিতায় তিনি রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল ঐক্য এবং সহিষ্ণুতার উপর, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

 

 

 

 

হাদি, অপরদিকে, একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর বিরুদ্ধে ছিলেন। হাদির রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে ছিল এক ধরনের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট মানবিক মূল্যবোধের জায়গা ছিল না। হাদি একাধিকবার বলেছিলেন, "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোট আনকোট, এইটার বিরুদ্ধেই জুলাই হয়েছে। দিবস হবে একটা ঐতিহাসিক ৩৬ এ জুলাই।" হাদি মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারকে অস্বীকার করেছিলেন রিপ্লেস করতে চেয়েছেন জুলাই দিয়ে, তিনি এক ধরনের একগুয়ে ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। 

 

 

 

 

নজরুলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহুত্ববাদী এবং একাধিক ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত। নজরুলের সাহিত্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য ছিল, এটা ধর্ম, জাতি বা লিঙ্গের সীমানা অতিক্রম করে মানবিক আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছিল। নজরুল তাঁর জীবনে কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় বিভেদ মেনে নেননি, উল্টো সকল মানুষের জন্য সমতা, মানবিকতা এবং শান্তির কথা বলেছেন। তাঁর কবিতা, গান এবং চিন্তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাথে সম্পর্কিত, যে চেতনা একত্রিত করার, বিভেদ দূর করার এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে।

 

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলাম দেশের সব ধর্ম, জাতি এবং সম্প্রদায়ের মানুষদের একত্রিত করার কথা বলেছিলেন। তাঁর কবিতায় যেমন “নাত-এ-রাসূল” লেখা হয়েছে, তেমনি “কৃষ্ণ কীর্তন” এর মতো গানের মধ্যে সকল ধর্মের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা ও মানবিকতার বার্তা। এই বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, হাদি এমন একটি রাজনৈতিক চিন্তাধারা ধারণ করেছিলেন, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে বৈধতা দিত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল।

 

 

 

 

জাতীয়তাবাদ, বিশেষ করে উপনিবেশ পরবর্তী বাংলাদেশে, একটি ইতিহাসের ব্যাপক বোঝাপড়া এবং মহান ব্যক্তিত্বদের প্রতি নৈতিক দায়িত্বের বিষয়।এখানে একটা সূক্ষ্ম, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীমারেখা রয়েছে, কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ এবং হাদির আদর্শের মধ্যে।এই দুটি আদর্শ একে অপরের থেকে একেবারেই বিপরীত। কেউ যদি কাজী নজরুলের কবিতা বা গানকে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করে, এতে কোন দোষ নেই, তবে সেটা কোনভাবেই কাজী নজরুলের কবরের পাশে শায়িত হওয়ার অধিকার সৃষ্টি করে না। হাদি যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তার মৃত্যু বা বিদ্ধি হওয়া তাকে কোনো “কাল্ট” ফিগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কারণ হতে পারে না।

 

 

 

 

এখানেই শেষ নয়, কালকে নজরুল পরিবার উদ্বেগ জানিয়েছেন , তারা মনে করেন, যদি হাদি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে শায়িত হন, তবে বিষয়টা নজরুলের কবরের নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।  

 

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি পবিত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্থান। তাঁর আদর্শ ছিল শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে, মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নজরুলের সাহিত্য ও গান ছিল জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে, মানবতার কথা বলা। 

 

আর একারণেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নজরুলের আদর্শের বিরোধী হাদির কবর তাঁর পাশে হওয়া গুরুতর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন। আমাদের মূল্যবোধের কঠিন পরীক্ষা।

 

 

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মুসলেমা পারভীন তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন: “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিদিন আমার বাস কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশ দিয়ে যেত। ফাইন আর্টস ভবনের সামনে ছাত্রছাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার পর বাস এগিয়ে যেত, কিন্তু আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে যতক্ষণ পারতাম কবির কবরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো আমি কতটা সৌভাগ্যবান! কতজন মানুষ প্রতিদিন নজরুলের কবর দেখতে পায়? হয়তো আর কখনো সেখানে যাওয়া হবে না, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, নজরুলের কবিতা আমার হৃদয়ের গভীরে বেঁচে আছে। তিনি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, আমাকে আজকের আমি বানিয়েছেন। অথচ দুঃখজনক যে, এই দেশের মাটিতে থেকেও অনেকে নজরুলকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেননি।”

 

 

 

 

মুসলেমার কথাগুলো পড়তে পড়তে বুঝলাম, তাঁর অভিজ্ঞতা আমার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কতটা মিলে যায়। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে বহুবার নজরুলের সমাধি ক্রস করেছি, একভাবে তাকিয়ে থেকেছি। মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। সেই মুহূর্তের গভীরতা ছিল অসীম।

 

 

 

 

আমাদের জন্য এই ধরনের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো কেবল ভৌত মূল্য নয়, এগুলো বহন করে আমাদের জাতি ও পরিচয়ের মূল সত্তা। ঠিক এই কারণেই হাদিকে নজরুলের কবরের পাশে সমাহিত করাকে এত বেমানান মনে হয়। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ, যতই জনপ্রিয় বা বিতর্কিত হোক না কেন, জাতীয় প্রতীকগুলোর পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার দিতে পারে না, বিশেষত যখন সেই মতাদর্শ নজরুলের প্রতিনিধিত্ব করা মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়ায়।