পুলিশের ওপর আস্থার সংকট কাটাতে সময় চাইলেন ডিএমপি কমিশনার

# ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ২২টি থানা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক যানবাহন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন পুলিশ বাহিনী ইতোপূর্বে কখনো হয়নি।
পুলিশের ওপর আস্থা ও সংকট কাটাতে আমরা কাজ করছি। এ জন্য একটু সময় প্রয়োজন। আমরা সবার সাপোর্ট চাই। সবার সাপোর্ট ছাড়া ট্রমা থেকে পুলিশ উঠে আসতে পারবে না।
শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ‘কমিশনার’স মিট দ্য প্রেস ‘ অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার মোঃ মাইনুল হাসান এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দিয়ে ঢাকা মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চেষ্টা করা হবে। আমাদের উপর আস্থা রাখুন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দিয়ে ঢাকা মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চেষ্টা করে যাবো।
বক্তব্যের শুরুতে ডিএমপি কমিশনার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আত্মাহুতি দানকারী বীর শহীদদের। গণঅভুত্থ্যানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি একই সাথে স্মরণ করছি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদ ও আহত পুলিশ সদস্যদের। সমবেদনা জ্ঞাপন করছি তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের অত্যন্ত সংকটকালে আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছি। বিগত সময়ের উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এর ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং বিগত সরকারের পতনকে ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। ডিএমপিসহ সারাদেশে অনেক পুলিশ সদস্য আহত এবং নিহত হয়েছেন। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। অনেক স্থানে আমাদের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। ট্রাফিকের প্রায় সকল অফিস ও বক্স ভাঙচুর হয়েছে। ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ২২টি থানা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক যানবাহন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন পুলিশ বাহিনী ইতোপূর্বে কখনো হয়নি।
তিনি আরো বলেন, এমন পরিস্থিতে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করি যাতে পুলিশ সদস্যগণ ভয় না পেয়ে দ্রুত কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ইতোমধ্যে কিছু উচ্চাবিলাসী ও অপেশাদার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপক ক্ষোভ জন্মায় এবং নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতি শুরু করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সুযোগ্য নেতৃত্বে আইজিপি, অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণসহ আমি নিজে রাজারবাগ ও মিরপুর পুলিশ লাইন্সসহ বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনায় যাই। তাদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করে কিছু দাবি তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়। বাকিগুলো দ্রুততম সময়ে মেটানোর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে পুলিশ সদস্যগণ তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসেন এবং পুলিশী দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এই সংকটকালে ভগ্ন মনোবলের পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের ভীতি দূর করণও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সারাদেশে প্রতিটি থানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণকে মোতায়েন করা হয়। তাদের উপস্থিতির ফলে ভীতসন্ত্রস্থ পুলিশ সদস্যগণসহ জনমনে আস্থা ফিরে আসে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণের সহায়তায় আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সকল থানার কার্যক্রমসহ ট্রাফিক বিভাগ ও অন্যান্য সকল বিভাগের কার্যক্রম দ্রুততার সাথে সচল করতে সক্ষম হই। এজন্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর সকল স্তরের সদস্যদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আমাদের এই সংকটকালে বিজিবি ও আনসার সদস্যগণও তাদের সার্বিক সহযোগিতা আমাদেরকে দিয়েছেন। এজন্য তাদের সকল সদস্য এবং বিজিবি ও আনসার মহাপরিচালককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এর পাশাপাশি ছাত্র-জনতাসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। তাদেরকে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
কয়েকজন ভিআইপিকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে আপনারা কী জানতে পেরেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনের ইস্যুতে রুজু হওয়া মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন। তাদের কেউ অর্থ, পরামর্শ ও বক্তৃতা কিংবা বিবৃতি দিয়ে উৎসাহিত করেছেন এসব বিষয় এই মুহূর্তে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।
অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব পুলিশ কর্মকর্তা নির্দেশ পালন করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরই মধ্যে কিছু পুলিশের নামে মামলা রুজু হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা একটি চলমান প্রক্রিয়া। তুলনামূলক সময় লাগতে পারে। বিভাগীয় ব্যবস্থার বিষয়টি চলমান রয়েছে।
যেসব অপেশাদার পুলিশ সদস্যরা গ্রেফতার হয়নি তারা এখন পলাতক কি না জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, তাদের বিষয়ে এখনও আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত নেই।
বিশেষ কয়েকটি জেলার পুলিশ সদস্যরা ডিএমপিতে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে ছিলেন। আপনার দায়িত্ব পালনকালে এসব বিশেষ জেলার কর্মকর্তাদের পদায়ন হবে কি না। এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমি এ বিষয়ে একমত না। পুলিশ বাহিনীর সবাই পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করবে। কে কোন জেলা থেকে এলো সেটি বিবেচনার বিষয় নয়। আমরা চাই একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনী তৈরি করতে। যেখানে সব পুলিশ সদস্যের কাজ হবে পেশাদার।
পুলিশে দুর্নীতি রোধে আপনি কী ব্যবস্থা নেবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা চাই পেশাদার পুলিশ বাহিনী তৈরি হোক। যেখানে কোনো দুর্নীতি, অনিয়ম ও অন্যায়ের স্থান থাকবে না।
আন্দোলন চলাকালীন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা অস্ত্র দিয়ে গুলি চালিয়েছিল। সেসব অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র যেমন ব্যবহার হয়েছিল আবার অবৈধ অস্ত্রও ব্যবহার হয়েছিল।
সবশেষে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঢাকা আপনার-আমার-সকলের প্রিয় শহর। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজে অংশ নেবেন না। যে যেখানে আছেন সবাই আইন ও বিধি মেনে চলুন। ঢাকা মেট্রাপলিটন পুলিশ সবসময় আপনাদের পাশে আছে। একই সাথে আমরা আপনাদেরও সহযোগিতা কামনা করি।
এ সময় ডিএমপির বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।