ঢাকা শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলবে যৌথ অভিযান


২৯ আগস্ট ২০২২ ০৩:৩৩

অস্ত্র হাতে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা -ছবি সংগৃহিত

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে আশ্রয়ের সন্ধানে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশে। গত ২৫ আগস্ট বিশ্বের আলোচিত এ সংকটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৮টি। তবে উদ্বেগজনক হলেও, গত এক বছরে মামলার সংখ্যা এর আগের চার বছরের মোট মামলার প্রায় সমান।

এসব মামলায় অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্লেষক ও সচেতন মহল ইতিবাচক বলে মনে করলেও হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বলেছেন, এটা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে বাড়ছে। যা আঞ্চলিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিও হতে পারে।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদকের বিস্তার রোধে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

গতকাল রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির পঞ্চম সভা শেষে তিনি একথা জানান।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আমরা মাঝে মধ্যেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করছি। বিনা কারণে রক্তপাতও দেখছি। মাঝে মধ্যে মিয়ানমার থেকে মাদকের আনাগোনাও লক্ষ্য করছি। এটার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা এবং অভ্যন্তরে গোয়েন্দা কার্যক্রম বন্ধের লক্ষ্যে তথ্যভিত্তিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তিনি বলেন, সেসব অভিযানে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার তো আছেই; যদি প্রয়োজন হয় সেখানে আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত হবেন। ওখানে এপিবিএন কাজ করছে।

মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে ও বাস্তবতার নিরিখে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার, পুলিশ, এপিবিএন- যৌথভাবে ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে অভিযান পরিচালনা করবে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন আমাদের এখানে অবস্থান করার কারণে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। বারবার প্রচেষ্টার পরেও তাদের দেশে যাওয়ার যে প্রক্রিয়াটা তাদের অনীহার কারণে শুরু করতে পারিনি। তারপরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঝে মধ্যেই রক্তপাত দেখছি, সন্ত্রাস দেখছি।

অস্ত্র দ্বারা তারা রক্তপাত করছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। এগুলো কোথা থেকে আসে কীভাবে আসে এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করবো শিগগির। এরা মিয়ানমারের মোবাইল ব্যবহার করে এতে ক্রিমিনালদের শনাক্ত করতে পারছি না। আমরা যেটা চাচ্ছি তারা যেন আমাদের দেশি মোবাইল ব্যবহার করে। আমরা যেভাবে মোবাইল নিয়ন্ত্রণ করি সেভাবেই করবো। একটি এসওপি করবো।

সভায় নেওয়া অন্যান্য সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সেগুলো কেন হচ্ছে আমরা তা খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি আরও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন প্রায় শেষ দিকে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, টহল রাস্তাও কিছুটা বাকি আছে, শেষের দিকে। ওয়াচটাওয়ার সেখানে হবে। তারা যেন সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকে সে ব্যবস্থা করছি।

আসাদুজ্জামান খান বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে জন্মনিরোধের জন্য একটি এসওপি তৈরির কাজ চলছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ইসলামি ফাউন্ডেশন এ নিয়ে কাজ করছে। ঘরে ঘরে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন এবং সচেতন করছেন। মসজিদের ইমাম ও এনজিওরাও এ বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছেন।
নাফ নদী যেটা আমাদের মাদক আনা-নেওয়ার রুট সেখানে মাছ ধরার ট্রলারের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতরে এবং বাইরে মাদক চোরাচালান বন্ধে অভিযান যেটা ছিল সেটা আরও জোরদার করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের নিতে আগ্রহ জানিয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিতে যেসব দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে সেগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করছি। আজ সিদ্ধান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোনো দেশ যদি আগ্রহ প্রকাশ করে, তারা কী পরিমাণ নেবেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। আমরা সেগুলোই খতিয়ে দেখছি। এখনও কোনো প্রস্তাব আমাদের কাছে আসেনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে। এ রকম যদি কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাদের আমরা বলবো অধিক সংখ্যক নেওয়ার জন্য। অধিক সংখ্যক নিয়ে এ সমস্যা যাতে দ্রুত শেষ হয় সেটাই ভালো।’

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার অগ্রগতির বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে ডে ওয়ান থেকেই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তখনকার সরকার প্রধান অং সান সুচির সঙ্গে আমিও ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছি, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও করেছেন। যাতে এগুলো দ্রুত শেষ হয় তা নিয়ে সব ভাবেই আলোচনার টেবিলে যাচ্ছি, প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আশা করি, এ সমস্যা আমরা শেষ করতে পারবো।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

অন্যদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরণের অপরাধে মোট ২ হাজার ৪৩৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে মোট আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ২২৬ জন।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫টি, মাদক উদ্ধার মামলা ১ হাজার ৬৩৬টি। ধর্ষণ মামলা ৮৮টি। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টায় মামলা হয়েছে ৩৯টি। এছাড়া ৫ বছরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ১১০টিরও বেশি। যদিও ৫ বছরে হত্যা মামলার সংখ্যা ১০০টি। যেখানে জোড়া খুন, ৬ খুনের ঘটনাও রয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪ বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা ও অন্যান্য আইনে ৮৯টি মামলা।

২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় ৪৪৯ জন রোহিঙ্গা আসামি হন। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫৬৭টি মামলায় ১ হাজারের ওপরে রোহিঙ্গা আসামি হয়েছিল। এতে গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ অপরাধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪০টি। যেখানে অস্ত্র উদ্ধার ৯৮টি, মাদক উদ্ধার ৮৭৪টি, ধর্ষণ ২৩টি ও হত্যা মামলা ৩০টি।
পরিসংখ্যান মতে, ক্যাম্পে আগের ৪ বছরের মামলার সংখ্যার প্রায় সমান মামলা হয়েছে গত এক বছরে।

রোহিঙ্গা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রহমান নাসির উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের সব শরণার্থী সংকট দীর্ঘায়িত হলে ২ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকে। যার একটি নিজেদের মধ্যে সংঘাত, অপরটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও এমনটিই হচ্ছে।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের ফলে সীমান্তে অবৈধ বাণিজ্যের হার বাড়ছে। স্থানীয়রাও মাদক ও অস্ত্র পাচারে রোহিঙ্গাদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। এদিকে অলস সময় পার করায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে রোহিঙ্গারা অবৈধ বাণিজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

রোহিঙ্গা নিয়ে এ গবেষক আরও জানান, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যত দেরি হবে ততটাই হুমকির মুখে পড়বে দেশ। প্রতিটি শরণার্থী সমস্যা জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। রোহিঙ্গা সংকট তার বাইরে নয়।

রোহিঙ্গা ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, মামলার সংখ্যা দিয়ে অপরাধ বিশ্লেষণ করা যাবে না। মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন। তবে কিছুটা অস্বাভাবিক বা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এপিবিএন ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত হওয়ার আগে ও পরের দৃশ্য ভিন্ন। এখানে কিছুটা পরিস্থিতির উন্নয়ন দেখা গেছে। বিশেষ করে অগ্নিসংযোগ বা অপহরণের ঘটনা কিছুটা কমেছে।