ঢাকা শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


চারদিকে তখন লাশ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, রক্তের বন্যা


২১ আগস্ট ২০১৯ ২২:২৬

ছবি সংগৃহিত

সে সকালে আমার প্রিয়তম মানুষটির হাতের আলতো স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙেছিল। আজ সকালটা অন্য রকম। বিদেশের মাটিতে একটি হাসপাতালে সে প্রিয়তম মানুষটির হাত ধরে বসে আছি। গত এক মাস চার দিন আগে ঢাকার একটি হাসপাতালে হঠাৎ ভর্তি করাতে হয়েছিল মানুষটিকে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে ফিরিয়ে আনবার প্রানান্ত চেষ্টায় দেশের মধ্যের সম্ভব সবটুকু করবার শেষে এক পর্যায়ে দেশের বাইরে নিয়ে আসতে হয়েছে। জানিনা ভবিষ্যৎ কি। চেষ্টা চলছে। খুব সামান্য হলেও কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি আছে। এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায়।পরিবার, নেত্রী, বন্ধু, সুহৃদ, সবার, বিশেষত আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের দোয়া, ভালোবাসা, শুভকামনা আর সহযোগিতা সঙ্গী ছিলো, আছে প্রতিটি মুহূর্তে। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। সবার কাছে দোয়া চাই। আমাদের সকল চেষ্টা যেন সফল হয়।

‘সকালে হাতের ওপর আলতো স্পর্শে ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখি আমার স্বামী পাশে বসে অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখ মেলতে দেখে নরম ধরা গলায় বললেন, ‘সেই ২১ আগস্টে আমার বউ জীবিত ফিরে এসেছিল। আল্লার কাছে কৃতজ্ঞ।’

মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো ফিরে গেলাম সেই ভয়াল বিকেলে। গ্রেনেড আর গুলির বিকট শব্দ, বারুদ আর রক্তের গন্ধ, ধোঁয়া, আহতদের আর্তচিৎকার, মানুষের ভয়ার্ত ছুটোছুটি, কান্না আর মৃত্যুর হাতছানি। আবার চোখদুটো বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নীরবে বললাম, ‘বেঁচে আছি, আমি কৃতজ্ঞ।’

সাথে সাথেই মনে হলো আমি আছি, অনেকেই আছি, আবার অনেকেই নেই। আইভি চাচী নেই, আদা চাচা নেই, কুদ্দুস নেই। আরও ১৯ জন নেই। সেই প্রচন্ড ভীড়ে আমার সামনে গায়ের সাথে সেঁটে দাঁড়ানো মহিলা আওয়ামী লীগের বোনটি নেই, যার রক্তে লাল হয়েছিলো আমার শাড়ী।

সেদিন প্রথমে দাঁড়িয়ে ছিলাম ট্রাকটির পশ্চিম দিকে যেদিক দিয়ে নেত্রীর গাড়ী ট্রাকের ওপরে থাকা মঞ্চের কাছে আসবে, যেখানে আইভি চাচী দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর নেতা কর্মীদের নিয়ে। গাড়ী আসবার কিছুক্ষণ আগে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে দাঁড়ানো দু’জন ডাক্তার, আমি আর রোকেয়া আপাকে ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন ভাই ডাকলেন ২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ এর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঢোকার করিডোরের সামনের ফুটপাথে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। বহু কষ্টে ভীড় ঠেলে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।

নেত্রী এলেন। বক্তব্য রাখলেন বিএনপি জামায়াতের গ্রেনেড বোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আয়োজিত সে শান্তি সমাবেশে। বক্তব্য শেষের পরপরই শুরু হয় নারকীয় তান্ডব। ১৩ টি গ্রেনেড (তখন ভেবেছিলাম বোমা) ছোড়া হলো পরপর। নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে নেত্রীকে ঘিরে মানববর্ম তৈরী করেছিলো ট্রাকের ওপরে থাকা নেতৃবৃন্দ। অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেলেন প্রানপ্রিয় নেত্রী। গ্রেনেড দিয়ে তাঁকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে তারপর শুরু হয় তাঁর গাড়ীকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ। তখন চারদিকের নারকীয় বিভৎসতার মধ্যে প্রচন্ড চাপের মধ্যে বসে পড়তে চেষ্টা করলাম গুলি এড়াতে। এর মধ্যেই দু’জন ছাত্রলীগ কর্মী আমার দু’হাত ধরে আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। চারদিকে তখন লাশ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, রক্তের বন্যা। হাজার হাজার জুতো স্যান্ডেল পড়ে আছে। কয়েক হাত যাবার পরেই আবার বিষ্ফোরণ।

ছবি: ফেসবুক থেকে

সে দু’জনের একজন চিৎকার করে বলেছিল, ‘আপা, পিছেনে তাকাবেন না।’ আমি যন্ত্রচালিতের মত পিছন ফিরে দেখলাম ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগেই যে স্থানটিতে ছিলাম সেখানে লাশ পড়ে আছে। রাস্তার কোনাটি ঘোরার আগেই বাঁদিকে দেখলাম দু’জন জিল্লুর চাচাকে আগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর হতবিহ্বল দু’চোখ মুহূর্ত আগেই দেখেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর রক্তে ভেজা দেহ।

রাস্তার মোড় ঘুরেই নির্মিয়মান বহুতল একটি ভবনের বেসমেন্টে ঢুকলাম। নানক ভাই, লাইলী আপাসহ আরও অনেকে সেখানে। ভেতর থেকে বন্ধ থাকা একটি অফিস কক্ষে অনেক অনুরোধ করে দরজা খুলিয়ে ভেতরে গেলাম। সবার একই উৎকন্ঠিত প্রশ্ন, নেত্রী কেমন আছেন? বেঁচে আছেন তো? নিজেদের বিধ্বস্ত রক্তাক্ত অবস্থার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, শুধু নেত্রী ঠিক আছেন, এটুকু জানার জন্য উন্মুখ সকলে।

নানা জায়গায় মোবাইলে খোঁজ নিচ্ছেন সবাই। প্রায় ফুরিয়ে এসেছে মোবাইলের চার্জ। বাসায় ফোন করে জানালাম, বেঁচে আছি, বাসায় ফিরবো। বাইরে তখন আহতদের সহযোগিতা করার বদলে চলছে পুলিশের লাঠিচার্জ আর টিয়ার শেল নিক্ষেপ। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। অনেকের নিষেধ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম। খালি পা, রক্তমাখা ছেড়া শাড়ী। পুলিশের সামনে দিয়েই হেঁটে রওনা হলাম। তাকিয়ে দেখলো, কিছু বললো না। পাশ দিয়ে দেখলাম অনেকগুলো দেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে একটি পিকআপ ভ্যান। তার মধ্যে কেউ জীবিত ছিল কি না জানি না।

হাঁটতে হাঁটতে সচিবালয়, হাইকোর্ট, মৎস্য ভবন, কাকরাইল, রমনা পার্ক পেরিয়ে শেরাটন হোটেলে গিয়ে পৌঁছুলাম। আমার গাড়ী সেখানে রাখা ছিলো। পথে উৎসুক কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, কি হয়েছে, কোথায় যাচ্ছেন। হামলার কথা শুনে বিচলিত হয়েছেন। কোন সাহায্য লাগবে কি না জানতে চেয়েছেন। মাথা নেড়ে হেঁটে চলেছি একটানা। হোটেলের ভেতরে ঢুকে লবীর দিকে যখন যাচ্ছি সাংবাদিক শফিকুর রহমান ভাইর সাথে দেখা। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন। বললেন কিছু একটা ঘটেছে শুনেছেন।

ছেলে টিউটরের কাছে শুনে ছুটে বেরিয়ে এসেছে মায়ের খোঁজে, মেয়েকে বন্ধুর বাড়ী থেকে আনা হয়েছে আমার মায়ের বাড়ীতে। সেখান থেকে বাসায় আসতে আসতে ১১ বছরের মেয়ের রাজনীতি এতো ভয়ংকর, এতো ঝুঁকিপূর্ণ হলে কেন রাজনীতি করি, এ প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করেছি। কলাবাগান থেকে উত্তরা, এই পথ পেরুনোর সময়টুকুতে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট এবং উদ্বুদ্ধ মেয়ে বাসায় পৌঁছে ঘরে ঢুকেই বাবাকে বলেছে, ‘বড় হয়ে আমি রাজনীতি করবো, বাবা।’

ছবি: ফেসবুক থেকে

হাসপতালে আহতদের চিকিৎসা যেন না পাওয়া যায়, অকুস্থলে কোন হামলার আলামত যেন পাওয়া না যায়, হামলাকারীদের যেন চিহ্নিত করা ও বিচার করা না যায়, এতোবড় হামলা ঘটেছে বিরোধীদলের নেত্রীর ওপর, পুরো বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য, তা নিয়ে সংসদে যেন কোন আলোচনা না হয়, তার সব ব্যবস্থা করেছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত সরকার। বরং মিথ্যাচার, জঘন্যতম মিথ্যাচার করেছিল, শেখ হাসিনাই নাকি তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ এ করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে নিজেদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক।শহরের নানা হাসপাতাল আর ক্লিনিকে যে যেখানে পেরেছে চিকিৎসা নিয়েছে। বেগম আইভি রহমানকে ঢাকা সিএমএইচ এ রেখে চালানো হয়েছে আরেক মর্মান্তিক নাটক। বেগম জিয়া তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাবার নির্মম নাটক করেছিলেন। আইভি চাচীর ছেলেমেয়েদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল সেসময়। গভীর রাতে ফোন করে তাঁর ছেলেকে বলা হয়েছে তার মা মারা গেছেন, তক্ষুনি নিয়ে যেতে হবে লাশ হাসপাতাল থেকে।

যারা হারিয়ে গেছেন চিরদিনের জন্য তাদের শোকার্ত পরিবারের কান্না, যারা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত হয়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল তাদের আর্তনাদ বেগম জিয়াকে বা তার পরিবারের, দলের ও সরকারের ষড়যন্ত্রকারীদের স্পর্শ করেনি।

তিনমাস প্রায় ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই গ্রেনেডের, গুলির শব্দ, রক্ত আর বারুদের গন্ধ, মানুষের আর্ত চিৎকার কানে বাজতো। চিন্তাও করতে পারি না যারা চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের যন্ত্রণার আর যারা হারিয়ে গেছেন তাদের স্বজনদের কষ্টের গভীরতা। শুধু ভাবি, বেঁচে আছি। তাই বারবার কৃতজ্ঞতা জানাই সৃষ্টিকর্তাকে। আমার ১৫ বছরের ছেলে সেসময় থেকেই বেশী করে বারবার ফোন করে মা কে আর কথা শেষ করেই বলে, ‘মা, তোমাকে খুব ভালোবাসি আমি।’ একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাবা, প্রতিদিন এতো বার বলিস কেনো?’ উত্তরে বলেছিল, ‘যখনই কথা বলি তোমার সাথে, ভয় হয়, হয়তো এবারই শেষ বার, তারপর হয়তো আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবার সুযোগ পাবোনা।’ এ কেমন বাস্তবতা একজন রাজনীতিকের জীবনের? দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কাজ করা কি অপরাধ? স্বাধীনতায়, মুক্তিযুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করা কি অপরাধ?

শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছিল তার পাঁচ মাস পরই। তাঁর কুলখানির দিন নেত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘রোজ সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খুললেই মনে হয় আল্লাহ আরেকটা দিন বাঁচিয়ে রেখেছেন। আরেকটা দিন সুযোগ দিয়েছেন দেশের মানুষের জন্য কাজ করার।’ এক সকালে পরিবারের শুধু ছোটবোনটি ছাড়া আর সবাইকে হারিয়ে কি নিদারুন কষ্ট বুকে বয়ে নিয়ে দেশ চালান, দল চালান বঙ্গবন্ধুকন্যা। যখন নেত্রীর সব হারাবার কথা ভাবি তখন মনে হয় কবে আমাদের দেশ থেকে দূর হবে এইসব ঘাতকের দল! শুধুমাত্র অসাম্প্রদায়িকতায়, গণতন্ত্রে, মানবিকতায় বিশ্বাসের জন্য গ্রেনেড, বোমা মেরে, গুলি করে, কুপিয়ে আর কত মানুষকে হত্যা করবে এই ‘৭১,‘৭৫, ২০০১-০৬, ‘১৩,‘১৪ আর ‘১৫ এর ঘাতকেরা? আর কতকাল মিথ্যাচারীরা ইতিহাসকে বিকৃত করবে, গুজব, অপপ্রচার দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করবার অপচেষ্টা চালাবে, দেশের সুনাম নষ্ট করবে? আর কতকাল পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা দেশে রাজনীতিবিদের মুখোশ পরে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করবে? আর কতকাল বখে যাওয়া, সন্ত্রাসী, দুর্নীতির বরপুত্র, জঙ্গী পৃষ্ঠপোষক এক তস্কর রাজনীতির লেবাসধারী হয়ে বিদেশের মাটিতে বসে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে? আর কতদিন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে কতিপয় নষ্ট, বর্ণচোরা মানুষ? আমরা আর কতদিন নিরপেক্ষতার নামে সাদা আর কালোকে, দেশপ্রেমিক আর দেশবিরোধীকে, মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির মানুষ আর প্রগতিবিরোধী, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থকারীকে এক পাল্লায় মাপবো?

একুশে আগস্টের নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, তাদের শোকসন্তাপ বয়ে বেড়ানো পরিবার পরিজনকে সমবেদনা জানাই, স্প্লিন্টারের আঘাতে আজও যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোদের প্রতি জানাই অশেষ ভালোবাসা আর নিরন্তর শুভকামনা। ঘৃনা জানাই ঘাতক আর সব ষড়যন্ত্রকারীর প্রতি। অপেক্ষায় আছি একুশে আগস্টের হত্যাকান্ডের বিচারের রায় পাবার।

(বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি (২১/০৮/২০১৮ইং) এই লিখাটি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)